খাওয়ার পর বাবা বললেন, পান খাবি? মিষ্টি পান?
আমি ঠোঁট লাল করে পান খেলাম। বাবা আমাকে কাঠের একটা বেঞ্চে শুইয়ে দিলেন। আমার মাথার নিচে দিলেন তাঁর হ্যান্ডব্যাগ, গায়ে পাতলা একটা চাদর। বাবা বললেন, আরাম করে ঘুম দে। চাঁদপুর এলে ডেকে তুলব। দূর থেকে চাঁদপুর শহর দেখতে অসাধারণ লাগে। হাজার হাজার বাতি জ্বলে। বাতির ছায়া পড়ে পানিতে। দেখলে পাগল হয়ে যাবি। চাঁদপুর আসুক আমি ডেকে তুলব। আমি বললাম, আচ্ছা।
জার্নির সময় আমার ঘুম হয় না। আমি সারাক্ষণ তোর পাশে বসে থাকব না। চা টা খাব, ডেকে ঘুরব, বুঝতে পারছিস?
পারছি।
হঠাৎ ঘুম ভেঙে যদি দেখিস আমি পাশে নেই তাহলে আবার ভয় পাবি নাতো?
না।
আমি একটু পরে পরে এসে তোর খোঁজ নিয়ে যাব।
আচ্ছা।
তোর যদি ঘুম ভেঙে যায়, এখানেই থাকবি। আমার খোঁজে বের হবি না। আমি যেখানেই থাকি তোর কাছে চলে আসব।
আচ্ছা।
বেড়াতে এসে মজা পাচ্ছিস তো বাবা?
পাচ্ছি।
বেশি মজা পাচ্ছিস, না অল্প মজা?
বেশি মজা।
বাবা আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে লাগলেন। আমি প্রায় সঙ্গে সঙ্গে ঘুমিয়ে পড়লাম। কতক্ষণ ঘুমিয়ে ছিলাম জানি না, ঘুম ভাঙ্গলো হৈ চৈ আর চিকারের শব্দে। জেগে উঠে দেখি স্টীমা’র থেমে আছে। খুব চেঁচামেচি হচ্ছে। আতংকে অস্থির হয়ে বাবাকে খুঁজলাম–দেখি বাবা পাশে নেই। শুধু বাবা না কেউই নেই। যে ঘরে শুয়ে ছিলাম সেই ঘরটা পুরো ফাঁকা। একা একা বসে থাকতে ভয় লাগছিল, বাবার নিষেধের কথা আর মনে রইল না, বের হলাম। স্টীমারের সব লোক ডেকের এক দিকে ভিড় করেছে। মনে হচ্ছে সবাই এক সঙ্গে কথা বলছে। লোকজনের কথাবার্তা থেকে বুঝলাম–একটা বাচ্চা ডেক থেকে পানিতে পড়ে গেছে। তাকে উদ্ধারের চেষ্টা করা হচ্ছে। তারপর শুনলাম বাচ্চা না বয়স্ক একজন লোক। লোকটা একবার ডুবে যাচ্ছে, একবার ভাসছে। লোকটার উপর সার্চ লাইটের আলো ফেলা হয়েছে। নদীতে প্রবল স্রোত। স্রোত কেটে লোকটা আসতে পারছে না। তার কাছে মোটা দড়ি ছুঁড়ে ফেলার চেষ্টা করা হচ্ছে। দড়ি সে পর্যন্ত যাচ্ছে না, বাতাসের ঝাপটায় অন্যদিকে চলে যাচ্ছে।
কখন যে আমি নিজেই লোকটাকে এক নজর দেখার জন্যে রেলিং এর কাছে চলে এসেছি এবং নদীর প্রবল স্রোতের দিকে তাকিয়েছি নিজেই জানি না। কাউকে দেখা যাচ্ছে না। চারদিকে ঘন কালো পানি। শুধু যে জায়গাটায় সার্চ লাইটের আলো পড়েছে সে জায়গাটা দেখা যাচ্ছে। সব লোক এক সঙ্গে হঠাৎ চেঁচিয়ে উঠলো–দেখা যায়, দেখা যায়। সার্চ লাইটের আলো সেইদিকে ঘুরে গেলো। আমিও দেখলাম–যে মানুষটা ডুবছে আর ভাসছে সে আর কেউ না, আমার বাবা। তখন আমার কোনো বোধশক্তি ছিল না। সিনেমা’র বড় পর্দার দিকে মানুষ যেভাবে তাকিয়ে থাকে, আমি সেই ভাবেই তাকিয়ে আছি। সিনেমা’র বড় পর্দায় অনেক রোমাঞ্চকর ঘটনা ঘটে। সেইসব ঘটনা দেখে আমরা ভয় পাই, রোমাঞ্চ বোধ করি। কিন্তু সেই ভয়, সেই রোমাঞ্চ কখনই আমাদের গভীরে প্রবেশ করে না। আমি ভয়ে কাঁপতে কাঁপতে সব দেখছি, কিন্তু সেই ভয় আমার ভেতরে ঢুকছে না। বাবা শেষবারের মত পানির উপর মাথা ভাসিয়ে ডুবে গেলেন। ডুবে যাবার আগে আকাশ পাতাল চিৎকার করে ডাকলেন, বাবলু। বাবলু। ও বাবলু।
বাবলু হচ্ছে আমার ডাক নাম।
আর এই হল আমার গল্প।
.
আমি রকিব সাহেবের দিকে তাকালাম। তার কপাল বেয়ে টপ টপ করে পানি পড়ছে। তিনি বড় বড় নিঃশ্বাস ফেলছেন। মাইক্রোবাস চলছে প্রায় একশ কিলোমিটার বেগে। রকিব সাহেব ট্রাক, নাইট কোচ সব একের পর এক ওভারটেক করে যাচ্ছেন। স্পীড আরো বাড়ছে। রকিব সাহেব এক হাত স্টিয়ারিং হুইলে রেখে অন্য হাতে নির্বিকার ভঙ্গিতে সিগারেট ধরাতে ধরাতে শান্ত গলায় বললেন, গল্পটা আপনার কেমন লাগলো?
আমি জবাব দিলাম না। রকিব সাহেব বললেন, আপনি খুব মন দিয়ে গল্পটা শুনেছেন। আপনাকে ধন্যবাদ। গল্পের শেষটা ইন্টারেস্টিং। শেষটা হচ্ছে–আমাকে অসহায় অবস্থায় রেখে বাবা মারা গেলেন, মৃত্যুর আগের মুহূর্ত পর্যন্ত তাঁর মাথায় ছিলাম আমি, যে কারণে মৃত্যুর পরেও তিনি আমার সঙ্গে সেঁটে রইলেন। এবং এখনো আছেন।
আপনার কথা বুঝতে পারলাম না।
অবিশ্বাস্য একটা ব্যাপার। বুঝতে না পারারই কথা। বাবা সবসময় আমার আশেপাশে থাকেন। এই যে আমি গাড়ি চালাচ্ছি তিনি কিন্তু পেছনের সীটে বসে আছেন। যতবার আমি স্পীড দিচ্ছি ততবার বলছেন–বাবলু আস্তে চালা। আপনি তা শুনতে পারছেন না। আপনার শুনতে পারার কথাও না।
আমি বিস্মিত হয়ে বললাম, ব্যাপারটা কি সাইকোলজিকেল, না?
রকিব সাহেব সিগারেটের ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে বললেন, আমি জানি আপনি তাই বলবেন। যে কোনো সেনসিবল মানুষই তাই বলবে। আমি নিজেও কিন্তু সেনসিবল মানুষ। এবং আমি জানি আসল ঘটনাটা কি। একবার কি হল শুনুন–জাপান থেকে যাচ্ছি লসএঞ্জেলেস, থাই এয়ারে। রাতের ডিনার শেষ করে ঘুমুতে যাব হঠাৎ শুনি বাবার গলা। বাবা বলছেন–বাবলু সীট বেল্ট বেঁধে নে। সামনে বিপদ।
সীট বেল্ট বাঁধার তখন কথা না। প্লেনের যাত্রীরা সবাই রিল্যাক্স করছে। বড় পর্দায় ছবি দেখছে। আমি বাবার কথা শুনে সীট বেল্ট বাঁধলাম তার কিছুক্ষণের মধ্যে প্লেন ভয়াবহ এক এয়ার পকেটে পড়ল। কত যাত্রী যে সীট থেকে ছিটকে পড়ল। ভয়ংকর অবস্থা। প্লেন থেকে মে ডে ডিক্লেয়ার করা হয়েছিল।