.
রকিবউদ্দিন ভূঁইয়া সাহেবের ক্ষমতা আমি ছোট করে দেখেছিলাম। তিনি যে কি পরিমাণ কলকাঠি নাড়তে পারেন সে সম্পর্কে আমার কোনো ধারণা ছিল না। তিনি কলকাঠি নাড়লেন। ট্রেনে উঠে দেখি ঠিক আমার টিকিটই ডাবল ইস্যু হয়েছে। অচেনা এক লোক আমার সীটে কম্বল গায়ে শুয়ে আছে। কম্পার্টমেন্টের এটেনডেন্টের সঙ্গে কথা বলতে গেলাম সে হাই তুলতে তুলতে বিরস গলায় বলল, স্টেশন মাস্টারের সঙ্গে কথা। বলেন। আমার কিছু করার নাই, টিকিটতো আর আমি ইস্যু করি নাই।
ট্রেন থেকে নেমে দেখি প্লাটফরমে দাঁড়িয়ে রকিব সাহেব সিগারেট টানছেন। আমাকে দেখে এগিয়ে এলেন। আমি বললাম, আপনি এখানে? তিনি বললেন, আপনাকে সি অফ করতে এসেছিলাম। সমস্যা কি?
আমি সমস্যার কথা বললাম।
তিনি বললেন, চলুন যাই স্টেশন মাস্টারের কাছে। মগের মুল্লুক নাকি? টিকিট ডাবল ইস্যু হবে? ছেলেখেলা?
স্টেশন মাস্টারের সঙ্গে দেনদরবার করতে করতে ট্রেন ছেড়ে দিল। বাধ্য হয়ে আমাকে রকিব সাহেবের মাইক্রোবাসে উঠতে হল। মাইক্রোবাস ছাড়ার সঙ্গে সঙ্গে আমার মনে হল ট্রেনের পুরো ব্যাপারটা ভদ্রলোকের সাজানো। ডাবল টিকিট তাঁর কারণেই ইস্যু হয়েছে। তিনি আমাকে তার মাইক্রোবাসে নিয়ে যেতে চেয়েছিলেন, শেষ পর্যন্ত তাই করছেন। আমার মনটাই খারাপ হয়ে গেলো।
রকিব সাহেব।
জ্বী।
ট্রেনের পুরো ব্যাপারটা আপনার সাজানো। তাই না?
জ্বী।
এটা কেন করলেন?
আপনাকে একটা গল্প বলতে চাচ্ছিলাম। সুযোগ পাচ্ছিলাম না। কাজেই সুযোগ তৈরি করে নিয়েছি। আমার ধারণা আপনি আমার উপর খুব রাগ করেছেন। হয়তোবা কিছুটা ঘৃণাও বোধ করছেন। তারপরেও আপনাকে গল্পটা শোনাবো।
কি গল্প? কিভাবে পথের ফকির থেকে কোটিপতি হলেন সেই গল্প?
জ্বি না সেই গল্প আমি কারো সঙ্গেই করি না।
আমাকে যে গল্প করতে যাচ্ছেন সেটা কি সবার সঙ্গেই করেন?
জ্বী না। আমার স্ত্রীকে বলার চেষ্টা করেছিলাম। সে পুরো গল্প মন দিয়ে শোনেনি। গল্পের মাঝখানে চা বানাতে গেছে, তার বান্ধবীকে টেলিফোন করেছে, ড্রাইভারকে পাঠিয়েছে ডিম কিনতে। তারপর থেকে আর কাউকে গল্পটা বলার চেষ্টা করিনি। আমি এমন একজন কাউকে চাচ্ছিলাম যে আমার গল্প মন দিয়ে শুনবে। ধরে নেয়া যেতে পারে আপনি এই গল্পের প্রথম এবং হয়তোবা শেষ শ্রোতা।
শুরু করুন আপনার গল্প।
গাড়ি চলছে প্রায় আশি কিলোমিটার বেগে। রাস্তায় প্রচুর ট্রাফিক। রকিব সাহেব স্টিয়ারিং ধরে বসে আছেন। আমি বসেছি তাঁর পাশে। গাড়িতে তৃতীয় ব্যক্তি নেই।
আমি বললাম, আপনি কি গাড়ি চালাতে চালাতেই গল্প বলবেন?
ভদ্রলোক হাসিমুখে বললেন, হ্যাঁ। আপনার ভয়ের কোনো কারণ নেই। আমি খুব ভাল ড্রাইভার। চোখ বন্ধ করেও গাড়ি চালাতে পারি। তারপরেও সাবধানের মা’র নেই। আপনি সীট বেল্ট বেঁধে নিন।
আমি সীট বেল্ট বাঁধলাম।
আপনার বা পাশে হ্যাংগারে চায়ের ফ্লাস্ক ঝুলছে। আপনি চা পছন্দ করেন। এই জন্যেই নিজে দাঁড়িয়ে থেকে চা বানিয়ে এনেছি।
রকিব সাহেব সিগারেট ধরালেন। তাঁর দুহাত স্টিয়ারিং হুইলে। এর মধ্যেই গল্প শুরু হল। ঠোঁটে সিগারেট নিয়ে গল্প বলতে এই প্রথম কাউকে দেখছি।
.
আমার তখন আট বছর বয়স। নয়ও হতে পারে, ক্লাস থ্রতে পড়ি। স্কুল গরমের ছুটি হয়েছে। আমি বাবার সঙ্গে বেড়াতে যাচ্ছি বরিশাল। আমার বাবা দরিদ্র মানুষ ছিলেন। কিন্তু তাঁর নেশা ছিল ঘুরে বেড়ানো। বাংলাদেশের হেন জায়গা নেই যে তিনি না গিয়েছেন। বাবা একা বেড়াতেই পছন্দ করতেন। মাঝে মাঝে আমি এবং আমার বড় ভাই তাকে এমনভাবে চেপে ধরতাম যে আমাদের সঙ্গে না নিয়ে তার উপায় থাকত না। বাবার সঙ্গে যাবার সুযোগ বেশিরভাগ সময়ই আমার বড় ভাইয়ের ঘটতো। বাবা আমাকে সঙ্গে নিতে চাইতেন না কারণ ছোটবেলায় বেশিরভাগ সময়ই আমি অসুস্থ থাকতাম। বাবার সঙ্গে বেড়াতে যাওয়া মানে প্রচুর হাঁটা, আমি একেবারেই হাঁটতে পারতাম না। ছেলে কোলে নিয়ে ঘুরে বেড়ানোয় কোনো আনন্দ নেই, কাজেই বাবা নানান অজুহাতে আমাকে বাতিল করে দিতেন।
সেবার কেন জানি নিজ থেকেই তিনি আমাকে সঙ্গে নিতে রাজি হলেন। মা ছাড়তে রাজি হলেন না–আমি মাত্র এক সপ্তাহ জ্বর থেকে উঠেছি, শরীর খুব দুর্বল। এমন রুগ্ন অসুস্থ ছেলেকে মা ছাড়বেন না। কান্নাকাটি করে মা’র অনুমতি আদায় করলাম। এবং এক সন্ধ্যায় হাসিমুখে বাবার হাত ধরে বরিশালে যাবার স্টীমারে উঠলাম। স্টীমারের নাম অসট্রিচ। বিশাল এক স্টীমা’র। যেন পানির উপর ভাসমান ছোটখাট এক শহর। স্টীমারে করে এই প্রথম আমার বাইরে কোথাও যাওয়া। আমি একেবারে অভিভূত হয়ে পড়লাম। স্টীমা’র ছাড়ার পর বাবা আমাকে কোলে নিয়ে ঘুরে ঘুরে সব দেখালেন। ফার্স্টক্লাস কেবিন, ডেক, রেস্টুরেন্ট, পানি ঘর, ইনজিন ঘর। ইনজিন ঘর দেখে আমি হতভম্ব। প্রকান্ড একটা ঘরের এ মাথা থেকে ও মাথা পর্যন্ত হাজার হাজার হাতুড়ির মত কি একটা যন্ত্র তালে তালে উঠছে আর নামছে–ভয়ংকর শব্দ হচ্ছে। আমি ভেবে পাচ্ছি না পৃথিবীর সপ্তম আশ্চর্যের তালিকায় স্টীমারের ইনজিন ঘরের নাম নেই কেন? এ পৃথিবীতে এরচে আশ্চর্যের আর কি হতে পারে?
স্টীমারের হোটেলে রাতের খাবার খেলাম। ইলিশ মাছ, ভাত, বুটের ডাল। কি যে ভাল রান্না শুধু খেতেই ইচ্ছা করে। ভরপেট খেয়ে ঘুম পেয়ে গেল।