আমি নৌকার খোঁজে গেলাম না। মুক্তিবাহিনীর ক্যাম্পে গিয়ে খবর দিলাম। রাত দু’টার সময় তারা এসে দিলদারকে ধরে নিয়ে গেল। দিলদার আমার স্ত্রীর দিকে তাকিয়ে একবার শুধু বলল, বহেনজি। তারপরই চুপ করে গেল। আমার স্ত্রী অবাক হয়ে আমার দিকে তাকিয়ে রইলো। দিলদারকে সেই রাতেই গুলী করে মারা হল। মৃত্যুর আগেও সে কয়েকবার আমার স্ত্রীকে ডাকল, বহেনজি। বহেনজি।
আমার স্ত্রী মারা গেল সন্তান হতে গিয়ে। একদিক দিয়ে ভালই হল। বেঁচে থাকলে সারাজীবন স্বামীকে ঘৃণা করে বাঁচতো। সে বাঁচা তো মৃত্যুর চেয়ে খারাপ।
.
বুঝলেন ভাই সাহেব, যুদ্ধ খুব খারাপ জিনিস। যুদ্ধে শুধু পাপের চাষ হয়। আমার মত সাধারণ একটা মানুষ কতগুলো পাপ করলো চিন্তা করে দেখেন। রোজ হাশরে আমার বিচার হবে। আল্লাহ পাক পাপ-পূণ্য কিভাবে বিচার করেন, আমাকে কি শাস্তি দেন এটা আমার দেখার খুব ইচ্ছা।
ব্যাধি
ভদ্রলোকের নাম রকিবউদ্দিন ভূঁইয়া। ভূঁইয়া গ্রুপ অব ইন্ডাস্ট্রিজের মালিক। কোটিপতি কিংবা কোটিপতির উপরে যদি কোন পতি থাকে সেই পতি। ভদ্রলোকের সঙ্গে কোথায় পরিচয় হয়েছিল মনে নেই। কোন পার্টি-টার্টি হবে, এই জাতীয় লোকদের সঙ্গে পার্টি ছাড়া দেখা হয় না। ভদ্রলোক বিনয়ী, কথা বলেন সুন্দর করে, তারপরেও তাকে আমার পছন্দ হয়নি। অসম্ভব বিত্তবান মানুষদের ভেতর চাপা অহংকার থাকে। তাদের বিনয়, ভদ্র ব্যবহার, সুন্দর কথাবার্তাতেও সেই অহংকার ঢাকা পড়ে না। নাটকের আবহ সঙ্গীতের মত, তাদের অহংকার সঙ্গীত সবসময় বাজতে থাকে।
এই জাতীয় লোকদের আমি দ্রুত ভুলে যেতে চেষ্টা করি। রকিবউদ্দিন ভূঁইয়াকে আমি সম্ভবত সেই কারণেই ভুলে গিয়েছিলাম। চিটাগাং নিউমার্কেটের দোতলায় তাঁর সঙ্গে দেখা হল। আমি তাকে চিনতে পারলাম না। তিনি খানিকটা বিস্ময়ের সঙ্গে বললেন, চিনতে পারছেন না? আমি রকিব। রকিবউদ্দিন ভূঁইয়া।
আমি বললাম, ঠিক মনে করতে পারছি না।
হোটেল শেরাটনে দীর্ঘসময় আপনার সঙ্গে কথা বলেছি।
আমি চিনতে পারার মত ভঙ্গি করে বললাম, ও আচ্ছা আচ্ছা।
তিনি আহত গলায় বললেন, এখনো চিনতে পারছেন না?
আমি বললাম, জ্বী না। আমার স্মৃতি শক্তি নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। মনে হয় আলজেমিয়ার ডিজিজ ফিজিজ হয়েছে। অতি পরিচিত কাউকে দেখলেও চিনতে পারি না।
ভদ্রলোক দুঃখিত গলায় বললেন, ঐ দিন আমি বেগুনী রঙের একটা টাই পরেছিলাম। আপনি বলেছিলেন, টাইটার রঙটাতো খুব সুন্দর।
তখন আমার মনে পড়ল। আমি বললাম, এখন মনে পড়েছে। আপনি ভুইয়া গ্রুপ অব ইন্ডাস্ট্রিজের মালিক।
ভদ্রলোক হাসলেন। তাঁকে খুব আনন্দিত মনে হল। তাঁকে চিনতে পারছিলাম না এই অপমান তিনি বোধহয় সহ্য করতে পারছিলেন না। ইনি বোধহয় ধরেই নিয়েছিলেন একবার যাদের সঙ্গে তার পরিচয় হবে তারা ইহ জীবনে তাকে ভুলবে না। দেখা হওয়া মাত্র আরে রকিব ভাই বলে ছুটে আসবে।
ভদ্রলোক হাসতে হাসতে বললেন, আমি ঐ বেগুনী টাইটা আলাদা করে রেখেছি। আমার স্ত্রীকে বলেছি, হুমায়ুন ভাই এই টাইটা পছন্দ করেছেন। বিশেষ বিশেষ অনুষ্ঠান ছাড়া আমি এই টাই আর পরব না।
আমি বললাম, ও আচ্ছা। আমার ও আচ্ছাতে খুব যে আনন্দ প্রকাশিত হল, তা না।
আপনার সঙ্গে এই ভাবে দেখা হয়ে যাবে জানলে বেগুনী টাইটা পরতাম।
আমি আবারো বললাম, ও আচ্ছা। এছাড়া আর কি বলব ভেবে পাচ্ছিলাম না। ভদ্রলোকের হাত থেকে উদ্ধার পাওয়া আমার বিশেষ প্রয়োজন। রাত এগারোটায় তূর্ণা নিশীথায় ঢাকা যাব। এখন বাজছে সাড়ে নটা। রাতের খাওয়া এখনো হয়নি। নিরিবিলি ধরনের কোন হোটেল খুঁজে বের করতে হবে। চিটাগাং-এ হোটেল টোটেলগুলি কোন অঞ্চলে তাও জানি না।
রকিব সাহেব বললেন, চিটাগাং-এ কি কোনো কাজে এসেছিলেন?
আমি বললাম, হ্যাঁ। মনে মনে ভদ্রলোকের কথায় বিরক্ত হলাম। অকাজে নিশ্চয়ই কেউ ঢাকা-চিটাগাং করে না। অকারণ প্রশ্ন করার মানে কি?
ঢাকা কবে ফিরবেন?
আজই ফিরব।
তূর্ণা নিশীথায়?
জ্বী।
আমি কি আপনার কাছে একটা প্রস্তাব রাখতে পারি?
রাখুন।
আমিও আজ ঢাকায় ফিরছি, বাই রোড। রাত এগারোটার দিকে রওনা হব। আমার সঙ্গে চলুন। গল্প করতে করতে যাব।
আমি বেশ কঠিন গলায় বললাম, না।
এখন ঢাকা-চিটাগাং হাইওয়ে এত সুন্দর হয়েছে…
যত সুন্দরই হোক, আমি ঠিক করেছি ট্রেনে যাব।
নতুন একটা লাক্সারী মাইক্রোবাস কিনেছি, ডাবল এসি, রিভলভিং সীটস, গাড়িতেই ফ্রিজ, টিভি…আপনাকে গাড়িটায় চড়াতে পারলে…
অন্য আরেক সময় আপনার গাড়িতে চড়ব। দয়া করে এই বিষয়ে আর কথা বলবেন না।
রকিব সাহেব শুকনো গলায় বললেন, আচ্ছা। ঠিক আছে।
আমি হাঁপ ছেড়ে বাঁচলাম। ভদ্রলোকের স্বভাব চিনেৰ্জোকের মত। যা ধরেন। ছাড়েন না। তাঁর হাত থেকে নিস্তার পেয়ে হাঁপ ছেড়ে বাঁচলাম। যেভাবে চেপে ধরেছিলেন, তাতে মনে হয়েছিল ছাড়া পাব না। তার সঙ্গেই যেতে হবে। এবং সারা পথ শুনতে হবে জীবনের শুরুতে তিনি কেমন দরিদ্র ছিলেন। পরে কি করে বিত্ত সঞ্চয় করলেন। বিত্তবানরা এ জাতীয় গল্প অন্যদের শুনিয়ে খুব আরাম পায়, যারা ধৈর্য করে শোনে তারা যা পায় তার নাম নির্যাতন। সাধ করে নির্যাতনের ভেতর দিয়ে যাবার কোনো অর্থ হয় না। অন্যের অভাবের গল্প শুনতে যেমন ভাল লাগে না, অন্যের বিত্তের গল্প শুনতেও ভাল লাগে না।