আমি বললাম, কি কথা?
ফুলি বলল, আমার কাছে আগে বোস। আমি বসলাম। ফুলি বলল, আমি যদি তোমার কাছে কোন জিনিস চাই তুমি কি আমাকে দিবে?
আমি বললাম, ক্ষমতার ভিতরে থাকলে অবশ্যই দিব। আকাশের চাঁদ চাইলে তো দিতে পারবো না। জিনিসটা কি?
তুমি আগে আমার গা ছুঁয়ে প্রতিজ্ঞা কর।
আমি তার কপালে হাত রেখে বললাম, প্রতিজ্ঞা করলাম। এখন বল ব্যাপার কি?
হারিকেনটা জ্বালাও।
হারিকেন জ্বালালাম। দেখি তার বালিশের কাছে একটা কোরআন শরীফ। আমাকে বলল, আল্লাহর পাক কালাম ছুঁয়ে প্রতিজ্ঞা কর যে তুমি কথা রাখবে।
আমি ধাঁধার মধ্যে পড়ে গেলাম। ব্যাপারটা কি? পোয়াতি অবস্থায় মেয়েদের মধ্যে অনেক পাগলামী ভর করে। আমি ভাবলাম এ রকমই কিছু হবে। দেখা যাবে আসল ব্যাপার কিছু না। আমি কোরআন শরীফে হাত রেখে প্রতিজ্ঞা করলাম। তারপর বললাম, এখন বল আমাকে করতে হবে কি?
একটা মানুষের জীবন রক্ষা করতে হবে।
তার মানে?
একটা মানুষ আমার কাছে আশ্রয় নিয়েছে। তার জীবন রক্ষা করতে হবে।
কিছুই বুঝতে পারছি না। কে তোমার কাছে আশ্রয় নিল?
ফুলি থেমে থেমে চাপা গলায় যা বলল তাতে আমার কলিজা শুকায়ে গেল। দুদিন আগে মিলিটারির লঞ্চডুবি হয়েছে। একটা মিলিটারী নাকি সাঁতরে কুলে উঠেছে। আমাদের বাড়ির পেছন দিকে কলা গাছের ঝোঁপের আড়ালে বসে ছিল। ফুলিকে দেখে বহেনজি বলে ডাক দিয়ে কেঁদে উঠেছে। ফুলি তাকে আশ্রয় দিয়েছে।
আমি হতভম্ব গলায় বললাম, দুদিন ধরে একটা মিলিটারী আমার বাড়িতে আছে? ফুলি বলল, হু।
সত্যি কথা বলছ?
হ্যাঁ, সত্যি। এখন তুমি তাকে মাধবখালী নিয়ে যাও। মাধবখালীতে মিলিটারী ক্যাম্প আছে। আজ ঝড় বৃষ্টির রাত আছে। অন্ধকারে অন্ধকারে চলে যাও। কেউ টের পাবে না।
তোমার কি মাথাটা খারাপ?
আমার মাথা খারাপ হোক আর যাই হোক তুমি আমার কাছে প্রতিজ্ঞা করেছ।
আমি মিলিটারী নিয়ে রওনা হব, পথে আমাকে ধরবে মুক্তিবাহিনী। দুইজনকেই গুলী করে মা’রবে।
এই রকম ঝড় বৃষ্টির রাতে কেউ বের হবে না। তুমি রওনা হয়ে যাও।
ব্যাটা আছে কোথায়?
আস, তোমাকে দেখাই।
সঙ্গে অস্ত্রশস্ত্র কি আছে?
কিছুই নাই। খালি হাতে সাঁতরে পাড়ে উঠেছে।
আমি মোটেই ভরসা পেলাম না। অস্ত্র থাকুক আর না থাকুক মিলিটারী বলে কথা। জেনেশুনে এ রকম বিপদজনক শত্রু শুধুমাত্র মেয়েছেলেদের পক্ষেই ঘরে রাখা সম্ভব। আমার মাথা ঝিমঝিম করতে লাগলো। আমি ক্ষীণ গলায় বললাম, হারামজাদা কই?
ফুলি আমাকে দেখাতে নিয়ে গেল। এমনিতে সে কোন কিছু না ধরে উঠে দাঁড়াতে পারে না। আজ দেখি হারিকেন হাতে গটগট করে যাচ্ছে।
রান্নাঘরের পাশে ভাড়ার ঘর জাতীয় ছোট একটা ঘর আছে। সেখানে চাল, ডাল পেঁয়াজ-টিয়াজ থাকে। ফুলি আমাকে সেই ঘরের কাছে নিয়ে গেল। দেখি ঘরটা তালাবদ্ধ। একটা মাস্টারলক তালা ঝুলছে। ফুলি তালা খুলল। হারিকেন উঁচু করে ধরলো। দেখি ঘরের কোনায় কম্বল বিছানো। কম্বলের উপর নিতান্তই অল্প বয়েসী একটা ছেলে বসে আছে। তার পরনে আমার লুঙ্গি, আমার পাঞ্জাবি। ঘরের এক কোনায় পানির জগ-গ্লাস। পাকিস্তানী মিলিটারীর সাহসের কত গল্প শুনেছি। এখন উল্টা জিনিস দেখলাম। ছেলেটা আমাকে দেখে ভয়ে শিউরে উঠলো। গুটিসুটি মেরে গেল। ফুলি তাকে ইশারায় বলল, ভয় নাই।
আমি হারামজাদাকে খুব আগ্রহ নিয়ে দেখছি। এত কাছ থেকে আগে কোনদিন মিলিটারী দেখিনি। এই প্রথম দেখছি। লুঙ্গি পাঞ্জাবী পরা বলেই বোধ হয় একে দেখাচ্ছে খুব সাধারণ বাঙ্গালীর মত। শুধু রঙটা বেশী ফর্সা আর নাক মুখ কাটা কাটা। আমি ফুলিকে বললাম, এর নাম কি?
ফুলি গড়গড় করে বলল, এর নাম দিলদার। লেফটেন্যান্ট। বাড়ি হল বালাকোটে। রেশমী নামের ওদের গায়ের একটি মেয়ের সঙ্গে ওর খুব ভাব। যুদ্ধের পর দেশে ফিরে গিয়ে সে মেয়েটাকে বিয়ে করবে। রেশমী যে কত সুন্দর তুমি বিশ্বাস করতে পারবে না। অবিকল ডানাকাটা পরী। রেশমীর ছবি দেখবে? দিলদারের পকেটে সবসময় রেশমীর ছবি। বালিশের নিচে এই ছবি না রাখলে সে ঘুমুতে পারে না।
কারো ছবি দেখারই আমার কোন শখ ছিল না। আমার মাথা তখন ঘুরছে। একি সমস্যায় পড়লাম। ফুলি তারপরেও ছবি দেখালো। ঘাগরা পরা একটা মেয়ে। মুখ হাসি হাসি। ফুলি বলল, মেয়েটা সুন্দর কেমন, দেখলে?
আমি বললাম, হু।
এখন তুমি ওকে মাধবখালি পৌঁছে দেবার ব্যবস্থা কর। আজ রাতেই কর।
দেখি।
দেখাদেখির কিছুনা। তুমি রওনা হও।
মাধবখালিতো পায়ে হেঁটে যাওয়া যাবে না। নৌকা লাগবে।
নৌকার ব্যবস্থা কর। ওকে পার করার জন্যে আজ রাতই সবচে ভাল। ভয়ে বেচারা অস্থির হয়ে গেছে। পানি ছাড়া কিছু খেতে পারছে না।
আমি শুকনা গলায় বললাম, দেখি কি করা যায়।
ফুলি মিলিটারীর দিকে তাকিয়ে আনন্দিত গলায় বলল, তোমার আর কোন ভয় নাই। আমার স্বামী তোমাকে নিরাপদে পৌঁছে দিবে। তুমি এখন চারটা ভাত খাও। মিলিটারী বাংলা ভাষার কি বুঝল কে জানে। সে শুধু বলল, শুকরিয়া বহেনজি। লাখো শুকরিয়া।
ফুলি ভাত বেড়ে নিয়ে এলো। তাকে খাওয়াতে বসলো। আমাকে বলল, তুমি দেরি করো না–চলে যাও।
.
আমি ছাতা হাতে বাড়ি থেকে বের হলাম। তখনো ঝুম বৃষ্টি চলছে। তবে বাতাস কমে গেছে। আমি দ্রুত চিন্তা করার চেষ্টা করছি। কি করা যায় কিছুই ভেবে পাচ্ছি না। স্ত্রীকে কথা দিয়েছি। আল্লার পাক কালাম ছুঁয়ে প্রতিজ্ঞা করেছি। সে প্রতিজ্ঞা রক্ষা করা দরকার। ছেলেটার জন্যে মায়াও লাগছে। বাচ্চা ছেলে। এরা হুকুমের চাকর। উপরওয়ালার হুকুমে চলতে হয়। তাছাড়া বেচারা জীবনই শুরু করে নাই। দেশে ফিরে বিয়ে শাদি করবে। সুন্দর সংসার হবে। আবার অন্যদিকও আছে। একে মাধবখালি পৌঁছে দিলে ঘটনা প্রকাশ হয়ে পড়বে। নৌকার মাঝিই বলে দিবে। কোন কিছুই চাপা থাকে না। তারপর রাজাকার হিসেবে আমার বিচার হবে। দেশের মানুষ আমার গায়ে থু দিবে। পাকিস্তানী মিলিটারী শুধু যে আমাদের পরম শত্রু তা না, এরা সাক্ষাত শয়তান। এদের কোন ক্ষমা নাই।