বুঝলেন ভাই সাহেব, ধলা বড় সুন্দর গ্রাম। একেবারে নদীর তীরে গ্রাম। নদীর নাম কাঞ্চন। মাছ খুবই সস্তা। জেলেরা নদী থেকে ধরে টাটকা মাছ বাড়িতে দিয়ে যায়। তার স্বাদই অন্য রকম। পনেরো বছর আগের কথা বলছি। এখনো সেখানকার পাবদা মাছের স্বাদ মুখে লেগে আছে। শীতের সময় বোয়াল মাছ থাকতো তেলে ভর্তি।
ধলা গ্রামের মানুষজনও খুব মিশুক। আজকাল গ্রাম বলতেই ভিলেজ পলিটিক্সের কথা মনে আসে। দলাদলি মারামারি কাটাকাটি। ধলা গ্রামে এই সব কিছুই ছিল না। শিক্ষক হিসেবে আমার অন্য রকম মর্যাদা ছিল। যে কোন বিয়ে শাদীতে আদর করে দাওয়াত দিয়ে নিয়ে যেত। গ্রাম্য সালিসীতে আমার বক্তব্য গুরুত্বের সঙ্গে নেয়া হতো। দুই বছর খুব সুখে কাটলো। তারপরই সংগ্রাম শুরু হল। আপনারা বলেন স্বাধীনতা যুদ্ধ। গ্রামের লোকের কাছে সংগ্রাম।
ধলা গ্রাম অনেক ভিতরের দিকে। পাক বাহিনী কোন দিন ধলা গ্রামে আসবে আমরা চিন্তাই করিনি। কিন্তু জুন মাসের দিকে পাক বাহিনীর গানবোট কাঞ্চন নদী দিয়ে চলাচল শুরু করলো। মাধবখালী ইউনিয়নে মিলিটারি ঘাঁটি করলো। শুরু করলো অত্যাচার। তাদের অত্যাচারের কথা আপনাকে নতুন করে বলার কিছু নাই। আপনি আমার চেয়ে হাজার গুণে বেশি জানেন। আমি শুধু একটা ঘটনা বলি। কাঞ্চন নদীর এক পাড়ে ধলা গ্রাম, অন্য পাড়ে চর হাজরা। জুন মাসের ১৯ তারিখ চর হাজরা গ্রামে মিলিটারির গানবোট ভিড়লো। চর হাজরার বিশিষ্ট মাতবর ইয়াকুব আলী সাহেব মিলিটারীদের খুব সমাদর করে নিজের বাড়িতে নিয়ে গেলেন। ভাই সাহেব, আপনি এর অন্য অর্থ করবেন না। তখন তাদের সমাদর করে নেয়া ছাড়া কোন উপায় ছিল না। সবাইর হাত-পা ছিল বাঁধা। ইয়াকুব আলী সাহেব মিলিটারীদের খুব আদর যত্ন করলেন। ডাব পেড়ে খাওয়ালেন। দুপুরে খানা খাওয়ার জন্যে খাসি জবেহ করলেন। মিলিটারীরা সন্ধ্যা পর্যন্ত থাকলো। খানাপিনা করলো। যাবার সময় ইয়াকুব আলী সাহেবের দুই মেয়ে আর ছেলের বউকে তুলে নিয়ে চলে গেল। আর তাদের কোন খোঁজ পাওয়া যায় নাই। এখন গল্পের মত মনে হয়। কিন্তু এটা বাস্তব সত্য। আমার নিজের দেখা। সেই দিনের খানায় শরিক হওয়ার জন্যে ইয়াকুব আলী সাহেব আমাকে দাওয়াত। দিয়েছিলেন। নিয়ে যাবার জন্যে নৌকা পাঠিয়েছিলেন। আমি গিয়েছিলাম।
চর হাজরার ঘটনার পরে আমরা ভয়ে অস্থির হয়ে পড়লাম। গজবের হাত থেকে বাঁচার জন্যে মসজিদে কোরআন খতম দেয়া হলো। গ্রাম বন্ধ করা হল। এক লাখ চব্বিশ হাজার বার সুরা এখলাস পাঠ করা হল। কি যে অশান্তিতে আমাদের দিন গিয়েছে ভাই সাহেব, আপনাকে কি বলব। রাতে এক ফোঁটা ঘুম হতো না। আমার স্ত্রী তখন সন্তানসম্ভবা। সাত মাস চলছে। হাতে নাই একটা পয়সা। স্কুলের বেতন বন্ধ। গ্রামের বাড়ি থেকে যে টাকা পয়সা পাঠাবে সে উপায়ও নাই। দেশে যোগাযোগ বলতে তখন কিছুই নাই। কেউ কারো খেজ জানে না। কি যে বিপদে পড়লাম। সোবহানাল্লাহ।
বিপদের উপর বিপদ-জুলাই মাসের শেষের দিকে মুক্তিবাহিনী দেখা দিল। নৌকায় করে আসে, দুই একটা ফুটফাট করে উধাও হয়ে যায়। বিপদে পড়ি আমরা। মিলিটারী এসে গ্রামের পর গ্রাম জ্বালায়ে দিয়ে যায়। মুক্তিবাহিনীর তখন আর কোন নাড়াচাড়া পাওয়া যায় না। সেপ্টেম্বর মাসের শেষের দিকে অবস্থার পরিবর্তন হল। মুক্তিবাহিনী তখন শুধু আর ফুটফাট করে না। রীতিমত যুদ্ধ করে। ভাল যুদ্ধ। বললে। বিশ্বাস করবেন না, এরা কাঞ্চন নদীতে মিলিটারীর একটা লঞ্চ ডুবায়ে দিল। লঞ্চ ডুবার ঘটনা ঘটলো সেপ্টেম্বর মাসের ছাব্বিশ তারিখ। স্বাধীন বাংলা বেতার থেকে এই সংবাদ প্রচার করা হয়েছিল। ভাই সাহেব হয়তো শুনেছেন। বলা হয়েছিল শতাধিক মিলিটারীর প্রাণ সংহার হয়েছে। এটা অবশ্য ঠিক না। মিলিটারী অল্পই ছিল। বেশির ভাগই ছিল রাজাকার। রাজাকারগুলা সাঁতরে পাড়ে উঠেছে, গ্রামের লোকরাই তাদের পিটিয়ে মেরে ফেলেছে। যুদ্ধ খুব খারাপ জিনিস ভাই সাহেব। যুদ্ধ অত সাধারণ মানুষকেও হিংস্র করে ফেলে। এটা আমার নিজের চোখে দেখা।
এখন মূল গল্পটা আপনাকে বলি। সেপ্টেম্বর মাসের ২৮ তারিখের ঘটনা। মাগরেবের নামাজ পড়ে বারান্দায় বসে আছি। তুমুল বর্ষণ হচ্ছে। ইংরেজীতে যাকে বলে ক্যাটস এন্ড ডগস। একা একা বৃষ্টি দেখছি। আমার স্ত্রী শোবার ঘরে। ঘর অন্ধকার করে শুয়ে আছে। তার শরীর খুব খারাপ। দুদিন ধরে কিছুই খেতে পারছে না। যা খায় বমি করে দেয়। শরীর অত্যন্ত দুর্বল। কোন কিছু না ধরে দাঁড়াতে পর্যন্ত পারে না। ডাক্তার যে দেখাব সে উপায় নেই। ডাক্তার পাব কই? মাধবখালিতে একজন এমবিবিএস ডাক্তার ছিলেন–বাবু নলিনী কুমা’র রায়। ভাল ডাক্তার। মিলিটারী মাধবখালীতে এসে প্রথম দিনই তাকে মেরে ফেলেছে।
যে কথা বলছিলাম, আমি বারান্দায় বসে বৃষ্টি দেখছি। মন অত্যন্ত খারাপ।
বৃষ্টির বেগ বাড়তে লাগলো। একসময় প্রায় ঝড়ের মত শুরু হলো। বাড়ি-ঘর কাঁপতে শুরু করলো। আমি একটু দুশ্চিন্তায় পড়ে গেলাম। পুরানো নড়বড়ে বাড়ি। ঝড়ে উড়িয়ে নিয়ে গেলে অসুস্থ স্ত্রীকে নিয়ে বিপদে পড়ব। কাছেই মোক্তার সাহেবের পাকা দালান। স্ত্রীকে নিয়ে সেখানে উঠব কিনা ভাবছি। তখন ফুলি আমকে ভেতর থেকে ডাকলো। আমি অন্ধকার ঘরে ঢুকলাম। ফুলি ফিস ফিস করে বলল, তোমার সঙ্গে আমার একটা কথা আছে।