বীনু কিছু বলল না। মজু আংকেল খানিকটা ঝুঁকে এসে বললেন, কবিতা শুনবে? বীনু না বলার আগেই ভদ্রলোক ভারী গলায় আবৃত্তি শুরু করলেন
ঘুমে চোখ চায়না জড়াতে,
বসন্তের রাতে।
বিছানায় শুয়ে আছি
একন সে কত রাত
ওই দিকে শোনা যায় সমুদ্রের স্বর
স্কাইলাইট মাথার উপর।
আকাশে পাখিরা কথা কয় পরস্পর।
বীনু কাঠ হয়ে বসে রইলো। মদ খেয়ে ভদ্রলোক কি মাতাল হয়ে গেছেন? বীনু এত কাছে থেকে কাউকে মদ খেতে দেখেনি। অনেক দূর থেকে একবার দেখেছে। যশোহরে মঞ্জু খালার বাড়িতে বেড়াতে গিয়েছিল। রাত এগারোটার দিকে শুনে ছাদে হৈ চৈ হচ্ছে। মঞ্জু খালা কার সঙ্গে যেন খুব রাগারাগি করছেন, কান্নাকাটিও করছেন। সে মঞ্জু খালার মেয়েকে জিজ্ঞেস করলো, কি হচ্ছেরে? সে বেশ স্বাভাবিক গলায় বলল, বাবা মদ খাচ্ছে তাই মা চেঁচামেচি করছে। বীনু আঁৎকে উঠলো। কি সর্বনাশ। সে কৌতূহল সামলাতে পারেনি। চুপিচুপি ছাদে দেখতে গিয়েছিল। ছাদে তখন খালা ছিলেন না। মেজো খালু সাহেব একা একা গ্লাস আর সবুজ রঙের একটা বোতল নিয়ে বসেছিলেন। বোতলটার রঙ কালোও হতে পারে। অন্ধকারে কিছু দেখা যাচ্ছিল না। সে ভেবেছিল আড়াল থেকে এক নজর দেখে চলে আসবে। কিন্তু খালু সাহেব তাকে দেখে ফেললেন, এবং অত্যন্ত মিষ্টি গলায় ডাকলেন, কে বীনু মা? আয় আয়। ছাদে খুব সুন্দর গোলাপের বাগান করেছি, বাগান দেখে যা। তোর মুখটা এমন শুকনো কেনরে মা? খালু সাহেবের কথাবার্তা এত সুন্দর এত স্বাভাবিক। কথা জড়ানো না কিছু না।
মজু আংকেলও খুব সুন্দর করে কথা বলছেন। মদ খেলে লোকজন হয়তো সুন্দর করে কথা বলে। তবে ভয়ংকর কথা বলে। এই ভদ্রলোক হয়তো জানেনও না তিনি কি ভয়ংকর কথা বলছেন। নগ্ন শরীরে চকচক করবে চাঁদের আলো। কি ভয়ংকর কথা!
মজু আংকেল হাসি মুখে তাকিয়ে আছেন। তিনি পাইপে টান দিতে দিতে বললেন, একদল রূপবতী তরুণী নগ্ন হয়ে সাঁতার কাটবে ভাবতেই ভাল লাগছে। ভিডিও করে রাখলে ভাল হত। এটাতে মনিকা রাজি হচ্ছে না। দেখি রাজি করানো যায় কি না। আজ থেকে কুড়ি বছর পর যখন তোমরা লোলচর্ম বুড়ি হয়ে যাবে তখন এই ভিডিও দেখে খুব ভাল লাগবে।
মজু আংকেলের গ্লাস শেষ হয়ে গিয়েছিল। তিনি আবার গ্লাস ভরতি করতে গেলেন।
মনিকার বন্ধুরা আসতে শুরু করেছে। এদের কাউকে বীনু চিনতে পারছে না। বীনু যেমন ওদের অবাক হয়ে দেখছে ওরাও বীনুকে অবাক হয়েই দেখছে। একটা অদ্ভুত পোশাক পরা মেয়ে ঘরে ঢুকেই বলল, আমাদের জলকন্যা সাজার প্রোগ্রাম ঠিক আছে তো? বীনু আবার ঘড়ি দেখলো। আটটা বাজে। তার ঘড়ি কি নষ্ট? এই প্রথম তার মনে হল সে ভুল করেছে। খুব বড় ভুল করেছে।
.
রাত কত বীনু জানে না। তার ঘড়িতে আটটা বেজে আছে। তবে রাত যে অনেক এ ব্যাপারে সে নিশ্চিত। সে এখন মনিকাদের ছাদের একটা বাথরুমে দরজা বন্ধ করে দাঁড়িয়ে আছে। জীবনে এত সুন্দর বাথরুম সে দেখেনি। কোনদিন হয়তো দেখবেও না। ধবধবে শাদা বিশাল একটা ঘর। সেই ঘরে নীল বাথটাব, নীল কমোড, নীল বেসিন। বাথরুমে নানান মাপের তোয়ালে। সেগুলোর রঙও নীল। আর কি বিশাল একটা আয়না। নিজেকে পুরোপুরি দেখতে হলে এরকম একটা আয়না লাগে।
মনিকার সব বান্ধবী সুইমিং পুলে নেমে গেছে। সুইমিং পুলে নামা’র আগে নাকি খুব ভাল করে গায়ে সাবান মেখে গোসল করে নিতে হয়। অন্যরা তাই করেছে। সে শুধু বাকি। সেওকি অন্যদের মত করবে? না দরজা বন্ধ করে বাথরুমে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কাঁদবে? মনিকা তাকে বলেছে, আমাদের জলকন্যা সাজার ব্যাপারটা যদি তোমার ভাল না লাগে তোমাকে জলকন্যা সাজতে হবে না। তুমি আমার ঘরে বসে ভিসিআরে ছবি। দেখ কিংবা গল্পের বই পড়। মজু আংকেল থাকবেন। তার সঙ্গে গল্পও করতে পার। আর তুমি যদি বাসায় চলে যেতে চাও তাও করতে পার। আমাদের ড্রাইভার আছে। ও তোমাকে নামিয়ে দিয়ে আসবে। রাত অবশ্যি অনেক বেশি হয়ে গেছে। তোমাকে দেখে মনে হচ্ছে তুমি এনজয় করছ না। তোমাকে কি নামিয়ে দিয়ে আসবে?
বীনু বলল, না। অথচ সে হ্যাঁ বলতে গিয়েছিল। তার মাথা বোধহয় এলোমেলো হয়ে গেছে।
সে জলকন্যা সাজতে চায় না। অথচ সে বাথরুমে দাঁড়িয়ে আছে। বাইরে বাজনা বাজছে। বাজনাটা কি সুন্দর। কি আশ্চর্য সুন্দর। মনিকার বান্ধবীদের খিলখিল হাসির শব্দ আসছে। এরা বোধ হয় একজন আরেকজনের গায়ে পানি ছিটাচ্ছে। এদের এই আশ্চর্য জীবনের সঙ্গে তার কোন যোগ নেই। এই বাড়ির ছাদে যে চাঁদ উঠেছে সেই চাঁদ তাদের বাড়ির ছাদে কখনো ওঠে না। মনিকাদের ছাদে পা দিয়েই চাঁদটার দিকে তাকিয়ে কি যে অদ্ভুত অন্য রকম লাগলো।
বীনু কাঁদছে। কাঁদতে কাঁদতেই সে তার গায়ের কাপড় খুলছে। সে জলকন্যা সাজছে।
পাপ
ভাই আপনাকে একটা ভয়ংকর পাপের গল্প বলি। পাপটা আমি করেছিলাম। নিজের ইচ্ছায় করিনি। স্ত্রীর কারণে করেছিলাম। স্ত্রীদের কারণে অনেক পাপ পৃথিবীতে হয়েছে। মানুষের আদি পাপও বিবি হাওয়ার কারণে হয়েছিল। আপনাকে এই সব কথা বলা। অর্থহীন। আপনি জ্ঞানী মানুষ, আদি পাপের গল্প আপনি জানবেন না তো কে জানবে। যাই হোক মূল গল্পটা বলি।
আমি তখন মাধবখালি ইউনিয়নে মাস্টারী করি। গ্রামের নাম ধলা। ধলা গ্রামের প্রাইমারী স্কুলের শিক্ষক। নতুন বিবাহ করেছি। স্ত্রী সঙ্গে থাকেন। আমার বয়স তখন পঁচিশের মত হবে। আমার স্ত্রী নিতান্তই বালিকা। পনেরো-যোলমত বয়স। ধলা গ্রামে আমরা প্রথম সংসার পাতলাম। স্কুলের কাছেই অনেকখানি জায়গা নিয়ে আমার টিনের ঘর। আমরা সুখেই ছিলাম। ফুলির গাছগাছালির খুব শখ। সে গাছপালা দিয়ে বাড়ি ভরে ফেলল। ও আচ্ছা, বলতে ভুলে গেছি ফুলি আমার স্ত্রীর ডাক নাম। ভাল নাম নাসিমা খাতুন।