মজু আংকেল মনিকার দিকে হাসি হাসি চোখে তাকিয়ে থেকে বললেন, তুমি সব কথাই ঠিক বলেছ তবে কনফারমড ব্যাচেলার কথাটা ঠিক বলোনি। পছন্দসই মেয়ে পাইনি বলেই ব্যাচেলার। আমি সারাক্ষণই পছন্দের মানুষ খুঁজে বেড়াচ্ছি। যখন কোন মেয়ের সঙ্গে দেখা হয় তখন প্রথমেই যে কথাটা মনে হয় তা হচ্ছে–এই কি সে? তোমার বান্ধবীকে দেখেও সেই কথাই মনে হচ্ছে এবং আমার মনে হচ্ছে এই হল সে।
মনিকা হাসতে হাসতে বলল, তাহলে তো আপনার সমস্যা সমাধান হয়েই গেল।
বীনু বুঝতেই পারছে না এসব কি ধরনের কথাবার্তা। বয়স্ক একজন মানুষ কি এই ধরনের কথা বলতে পারেন? না বলা উচিত? কি করে তিনি বললেন, এই হল সেই মেয়ে। ছিঃ ছিঃ।
মনিকা চলে যাচ্ছে। যাবার আগে বলল, মজু আংকেল আপনি কিন্তু বীনুর সঙ্গে সিরিয়াস কোন রসিকতা করবেন না। সে আপনাকে প্রথম দেখছে। আপনার রসিকতা বুঝতে পারবে না। ঘাবড়ে যাবে। আপনি বরং ওকে ম্যাজিক টেজিক দেখান।
.
মনিকা চলে গেছে। একা একা এই ভদ্রলোকের পাশে বসে থাকতে বীনুর প্রচন্ড ভয় লাগছে। তার শুধুই মনে হচ্ছে তিনি বলবেন,–দেখি তোমার হাত দেখি। আমি হাত দেখতেও জানি। বীনুর ফুপাতো বোন সুরমা আপার বাসায় এরকম হল। বীনু সুরমা আপার ছেলের আকিকায় গিয়েছিল। সেখানে দেখা গেল আসর জমিয়ে এক ভদ্রলোক বসে আছেন। ইঞ্জিনিয়ার। বেশ বয়স্ক, মাথার চুল সবই পাকা। তিনি নাকি খুব ভাল পামিস্ট, হাত দেখে সব বলে দিতে পারেন। সবাই হাত দেখাচ্ছে। সুরমা আপা বলল, বীনু তোর হাত দেখা না। বীনু বলল, না। ভদ্রলোক খপ করে বীনুর হাত টেনে নিলেন। তারপর হাত আর ছাড়েনই না। এইভাবে ধরেন ঐভাবে ধরেন। রীতিমত কচলানো। মজু আংকেলও কি এই রকম কিছু করবেন? বীনু ঘড়ি দেখলো, আটটা বাজে। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে এই প্রথম তার মনে হল ভুল হয়েছে। মনিকার জন্মদিনে আসা ভুল হয়েছে।
মজু আংকেল বোধহয় বীনুর ভয় বুঝতে পারছেন। তাঁর পাইপ নিভে গেছে। তিনি পাইপ ধরাতে ব্যস্ত। দেয়াশলাইয়ের আগুন বারবার নিভে যাচ্ছে। বীনু প্রায় মূর্তির মতই বসে আছে। ভদ্রলোকের পাশে বসেছে বলে সে ভদ্রলোকের মুখ পরিষ্কার দেখতে পারছে না। বীনুর মনে হল ভদ্রলোক হাসছেন। মজু আংকেল পাইপে লম্বা টান দিয়ে ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে বললেন, তোমার নাম হচ্ছে বীনু তাই না? বীনা থেকে বীনু।
বীনু মাথা নাড়াল। তার নাম বীনু ঠিকই তবে বীনা থেকে কি না তা জানে না।
তুমি কি আমাকে ভয় পাচ্ছ?
জ্বি না।
তোমার ভাবভঙ্গি দেখে মনে হচ্ছে ভয় পাচ্ছ। ভয় পাবার কিছু নেই।
আমি ভয় পাচ্ছি না।
তুমি থাক কোথায়?
কলা বাগানের পেছনে ভূতের গলি নামে একটা জায়গায়।
ভূতের গলি নাম কি জন্যে? ভূত আছে?
বীনু জবাব দিল না। সে আবার ঘড়ি দেখল। আশ্চর্য এখনো আটটা বাজে। ঘড়িটা কি বন্ধ হয়ে গেছে?
তোমার বাবা কি করেন?
ব্যাংকে চাকরি করেন।
কোন ব্যাংকে?
সোনালী ব্যাংকে।
কোন ব্রাঞ্চ?
নীলক্ষেত ব্রাঞ্চ।
উনার পোস্ট কি?
ক্যাশিয়ার।
উনার কাজ তাহলে পরের টাকা গোনা?
বীনু জবাব দিল না। তার মনে হল তার বাবা ক্যাশিয়ার এটা শোনার পর মজু আংকেলের উৎসাহ কমে গেছে। এবং তিনি বোধ হয় একটু বিরক্তও বোধ করছেন। কেমন যেন সরু চোখে তার দিকে তাকালেন। ভদ্রলোকের পাইপ আবার নিভে গেছে। তিনি আবারো পাইপ ধরাতে ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন। পাইপ ধরাবার পর লম্বা করে ধোয়া ছেড়ে বীনুর দিকে তাকিয়ে কি একটা বলতে গিয়েও বললেন না–উঠে হল ঘরের দিকে গেলেন। বীনু আবার ঘড়ি দেখলো। এখনো আটটা বাজে। ঘড়িটাকি নষ্ট হয়ে গেছে? মজু আংকেল ফিরে আসছেন। তার হাতে পেটমোটা লম্বা একটা গ্লাস। গ্লাসে লেবুর টুকরা ভাসছে। বীনু শিউরে উঠল। ভদ্রলোকের হাতে কি মদের গ্লাস? মদ খেলে মানুষ অদ্ভুত কাণ্ড করে বলে সে শুনেছে। মদ খাবার এক পর্যায়ে সবাই বমি করে। ইনিও নিশ্চয়ই করবেন। উনি কি করবেন কে জানে। এত কাছ থেকে সে কখনো কাউকে মদ খেতে দেখেওনি। ভদ্রলোক একবারে তার সামনে বসে আছেন।
বীনু?
জ্বি।
মনিকার সব জন্মদিনে আমি থাকি। তোমাকে এই প্রথম দেখলাম।
বীনু কিছু বলল না। ভদ্রলোক ছোট ছোট চুমুক দিয়ে গ্লাস ভর্তি জিনিসটা খাচ্ছে। খাওয়ার ভঙ্গি দেখে মনে হচ্ছে তার খেতে ভাল লাগছে না। মজু আংকেল এবার পুরোপুরি তার দিকে ফিরে তাকিয়ে বললেন, মনিকার সব জন্মদিনে আমাকে নতুন নতুন ফান আইডিয়া বার করতে হয়। আই এম রানিং আউট অব আইডিয়াস। আমি মনিকাকে বলেছি–এই শেষ, আর আমার কাছে আইডিয়ার জন্যে আসবে না। এবারের ফান আইডিয়াটা কি তুমি জান?
বীনু ক্ষীণস্বরে বলল, না।
তোমাকে দেখে আমারো মনে হচ্ছে তুমি জান না–সুইমিং পুলে গোসলের কথা তোমাকে বলেনি?
জ্বি বলেছে।
ও, তাহলেতো তুমি জান। আইডিয়া আমার দেয়া, আমি নিম্ফ সাজার আইডিয়া দিয়েছি। নিম্ফ কি জান?
জ্বি না।
নিম্ফ হচ্ছে পরী যারা জলকেলি করতে ভালবাসে—জলকন্যা। আমি বলেছি আজ পূর্ণিমা’র রাত আছে। গভীর রাতে তোমরা সব বান্ধবীরা মিলে সুইমিং পুলে নেমে যাবে। ছাদের সব বাতি থাকবে নেভাননা। চাঁদের আলো পড়বে সুইমিং পুলের পানিতে। দূরে বাজবে সিম্ফনী –মুনলিট সোনাটা। পানিতে ভেসে বেড়াবে একদল জলকন্যা। এ ওর গায়ে পানি ছিটাবে, খিলখিল করে হাসবে। তাদের গায়ে কোন কাপড় থাকবে না। কারণ জল কন্যাদের গায়ে কাপড় থাকে না। তাদের নগ্ন শরীরে চকচক করবে চাঁদের আলো। অসাধারণ একটা দৃশ্য, তাই না?