মনিকার চোখে বীনু খুব ছোট হয়ে আছে। বীনু ভেবে রেখেছে জন্মদিনের অনুষ্ঠানে সুযোগ পেলে সে মনিকাকে তার কথাগুলো বলবে। তারা যেহেতু সারারাত থাকবে সুযোগ নিশ্চয়ই পাওয়া যাবে। সমস্যা একটাই বাবার অনুমতি। বীনু ঠিক করল সে কেঁদে দাদীজানের পায়ে পড়ে যাবে। তিনি একটা ব্যবস্থা করবেন। অবশ্যই করবেন।
.
তিনি ব্যবস্থা করলেন। কিভাবে করলেন বীনু জানে না। জানতেও চায় না। সে বিস্ময়ের সঙ্গে তার বাবাকে বলতে শুনলো–ওরা থাকে যেন কোথায়?
গুলশানে।
ওদের টেলিফোন নাম্বার জান?
জ্বি জানি।
ঐ বাড়ির ঠিকানা, টেলিফোন নাম্বার একটা কাগজে লিখে যাও। জহির তোমাকে নামিয়ে দিয়ে আসবে, বাসাটাও চিনে আসবে। আমি রাতে তোমার খালার বাসা থেকে একবার টেলিফোনে খোঁজ নেব।
তার দরকার নেই বাবা।
অবশ্যই দরকার আছে। আরেকটা কথা তোমাকে বলি, তুমি আজ যা করছ তা ঠিক না। অন্যায়। আমার মা মৃত্যুশয্যায়–তিনি একটা কথা বললেন, ফেলতে পারলাম না। মায়ের আদেশ আমি কোনদিনই অগ্রাহ্য করি নি। যতদিন বাঁচবেন অগ্রাহ্য করবো না। এখন যাও, টেলিফোন নাম্বার, ঠিকানা সুন্দর করে কাগজে লিখে ফেল।
বাবা তাকে তুই তুই করে বলেন, এখন তুমি করে বলছেন। বাবার মনটন যে অসম্ভব খারাপ সেটা বোঝা যাচ্ছে।
বন্ধুর জন্মদিন খালি হাতে যাওয়া ঠিক না। আমি উপহার কিনে নিয়ে আসছি। সাথে করে নিয়ে যাও।
জ্বি আচ্ছা।
ইদ্রিস সাহেব চারটা গ্লাসের একটা সস্তা সেট নিয়ে এলেন। এই উপহার মনিকার হাতে দিলে বীনা নিজেই লজ্জায় মরে যাবে এবং চারদিকে হাসাহাসি পড়ে যাবে।
.
সন্ধ্যা সাতটার সময় যাওয়ার কথা বীনু ঘড়ি ধরে ঠিক সন্ধ্যা সাতটার সময়ই উপস্থিত হল। বড়লোকের বাড়ি সবই নিশ্চয়ই নিয়ম মত হবে। গিয়ে দেখে সে ছাড়া আর কেউ আসেনি। মনিকা নিজেও সাজগোজ কিছু করেনি। গোসল করার জন্যে বাথরুমে শুধু ঢুকতে যাচ্ছে। সে বীনুকে দেখে বলল, ও আচ্ছা, তুমি চলে এসেছ। অন্যরাতত কেউ আসেনি। সারারাত থাকবে তো ধীরে সুস্থে আসছে। তুমি কি সারা। রাত থাকবে না চলে যাবে?
থাকব।
বাসায় অসুবিধা থাকলে রাত দশটা এগারোটার দিকে চলে যেতে পার। গাড়ি আছে, গাড়ি দিয়ে আসবে।
না, অসুবিধা হবে না।
অসুবিধা না হলে খুব ভাল। আমরা সারারাত ফান করব। তুমি এখন টিভি দেখ বা বই টই পড়। মজু আঙ্কেল টেলিফোন করেছেন, কিছুক্ষণের মধ্যে চলে আসবেন। তখন তার সঙ্গে গল্প করতে পারবে।
উনি কে?
বাবার বন্ধু। আমাদেরও বন্ধু। ম্যাজিক টেজিক অনেক কিছু জানেন। ফান করার আইডিয়াতে তার মাথা একেবারে ভর্তি।
বীনু বলল, তোমাদের বাড়িটা কি একবার ঘুরে দেখব? এত সুন্দর বাড়ি আমি জীবনে দেখিনি।
দেখ, ঘুরে ঘুরে দেখ। রহিমাকে বলে দিচ্ছি ও তোমাকে সব ঘুরে ঘুরে দেখাবে। কি খাবে? চা, কোল্ড ড্রিংকস বা অন্য কিছু?
না।
আমাদের ডিনারের কিন্তু দেরি হবে। আজকে আমাদের ডিনার খাওয়াচ্ছেন মজু আঙ্কেল। বিশেষ একটা খাবার তৈরি হচ্ছে। সেটা আসবে রাত এগারোটার দিকে। ভাল কথা, তুমি কি সুইমিং কস্টিউম এনেছ? ও আচ্ছা, তোমাকে বোধ হয় বলা হয়নি আমাদের বাড়ির ছাদে সুইমিং পুল আছে। গভীর রাতে আমরা সবাই সুইমিং পুলে সাঁতার কাটতে কাটতে গান শুনব। তুমি কি সাঁতার জান?
বীনু সাঁতার জানে। তার নানার বাড়ির পুকুরে দাপাদাপি করে ছোটবেলাতেই সাঁতার শিখেছে। তারপরেও বলল,–সাঁতার জানি না। তার এতগুলো মেয়ের সঙ্গে পানিতে নামতে ইচ্ছা করছে না। তাছাড়া তার মনে ক্ষীণ সন্দেহ হচ্ছে পানিতে মজু আংকেল নামের ভদ্রলোকও নামবেন।
.
রহিমা মধ্যবয়স্ক হাসি খুশি একজন মহিলা। তার পরনের শাড়িটা পরিষ্কার, পায়ে সুন্দর চামড়ার স্যান্ডেল। মনিকা আগে বলে না দিলে বীনা তাকে মনিকার মা বা তার কোন আত্মীয় ভেবে পা ছুঁয়ে সালাম করে ফেলতো। রহিমা’র মা বীনাকে খুব খুশি মনেই ঘুরে ঘুরে বাড়ি দেখালো। লাইব্রেরী ঘর, কম্পিউটার ঘর, বার, হল ঘর, গ্যালারি, লন্ড্রি রুম। মাথা ঘুরে যাবার মত অবস্থা। রহিমা’র কাছ থেকেই বীনা জানতে পারল মনিকার বাবা মা দেশে নেই। মনিকার মা’র হার্টে স্পেসমেকার লাগানো আছে। সেখানে কি যেন সমস্যা হচ্ছে। লন্ডনে ডাক্তার দেখাতে গেছেন। মনিকার বাবাও গেছেন সঙ্গে। আজকের জন্মদিনে মনিকার আত্মীয়-স্বজন সবাইকে আসতে নিষেধ করা হয়েছে। আজ শুধু তার বন্ধু-বান্ধবরা থাকবে। মজু আংকেল থাকবেন কারণ ফান আইডিয়া সব তার মাথাতেই আসে।
মনিকার বান্ধবীরা এখনো আসেনি। তবে মজু আংকেল এসে গেছেন। লম্বা একজন মানুষ। গায়ের রং সাহেবদের মত দুধে আলতায়। মুখে ফ্রেঞ্চকাট দাড়ি। সর্বক্ষণ পাইপ টানছেন। তাকে ঘিরে আছে তামাকের গন্ধ। তবে সেই গন্ধ খারাপ লাগছে না। ভদ্রলোক গরমের মধ্যেও হলুদ একটা কোট পরে আছেন। কোটটা অন্য সব কোটের মত না। পাঞ্জাবির মত লম্বা। মনিকা তাকে বীনুর সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিল।
মজু আংকু, এর নাম বীনু। আমার সঙ্গে পড়ে। কেউতো এখনো আসেনি, তার বোধ হয় একা একা লাগছে। আপনি তাকে একটু কোম্পানী দিন। আমার সাজগোজ কিছুই এখনো হয়নি। আর বীনু শোন, মজু আংকেলের কথাতো তোমাকে আগেই বলেছি। আর্কিটেক্ট। কনফারমড ব্যাচেলার। তার যে কি পরিমাণ টাকা আছে তিনি তা নিজেও জানেন না। দারুন ক্লোজআপ ম্যাজিক দেখাতে পারেন। আজও দেখাবেন, সেই জন্যেই হলুদ কোট পরে আছেন। তাঁর যাবতীয় ম্যাজিক কোটের ভেতরে।