ইদ্রিস সাহেব শান্ত গলায় বললেন, শরীরে বিষ ঢুকে গেলে মন্ত্র পড়ে বিষ নামাতে হয়। সেই মন্ত্র আমি জানি। যাও–ঘরে যাও, আমি আসছি। তোমার মাকে বল উপস্থিত থাকতে।
বীনুর খুব ইচ্ছা হল দরজা খুলে ছুটে ঘর থেকে বের হয়ে যায়। তারপর রাস্তা ধরে দৌড়াতে থাকে। রাস্তার দু পাশে যদি কোন বাড়ি থাকে এবং তার দরজা খোলা থাকে তাহলে সে সেই খোলা দরজা দিয়ে ঢুকে পড়বে এবং বাড়ির মালিককে বলবে—-আপনাদের কোন কাজের বুয়া লাগবে?
যাই হোক বীনু সেই সব কিছুই করল না। সে তার মাকে সঙ্গে নিয়ে শোবার ঘরে খাটের উপর বসে রইল। বাতি জ্বালালো না। যথাসময়ে ইদ্রিস সাহেব এলেন এবং মেয়ের চুলের মুঠি ধরে হ্যাচকা টান দিলেন। মেয়ে বড় হয়েছে তার গায়ে হাত দেয়া যায় না। তাকে শাস্তি দিতে হলে চুলের মুঠি ধরেই দিতে হয়। পরবর্তী আধঘন্টা ইদ্রিস সাহেব শাস্তি দিলেন। তার হাত ভর্তি মুঠো মুঠো চুল উঠে আসতে লাগলো। বীনুর মা পাশেই দাঁড়িয়ে রইলেন। অন্ধকারে তার মুখ দেখা গেল না। দেখা গেলে দেখা যেত। শাস্তি প্রক্রিয়ায় তাঁর অনুমোদন আছে। শাস্তির শেষে বীনু মরার মত মেঝেতে পড়ে রইলো। ইদ্রিস সাহেব স্ত্রীর দিকে তাকিয়ে বললেন–যন্ত্রণা ঘরে রেখে লাভ নেই। বিয়ে দিয়ে দাও। আমার দায়িত্ব শেষ হোক। হাতে ছেলে একটা আছে, বয়স সামান্য বেশি। পুরুষ মানুষের জন্যে বয়স কোন বড় ব্যাপার না। বীনুর মা বললেন–তুমি যা ভাল বোঝ কর।
সেই ছেলেটির সঙ্গে বীনুর বিয়ে হয়ে যেত। ঠেকালেন বীনুর দাদীজান। বীনু তার কাছে কেঁদে গিয়ে পড়েছিল। তিনি ছেলেকে ডেকে নিয়ে শান্ত গলায় বললেন, বীনুর নাকি বিবাহের কথা চলতেছে?
ইদ্রিস বললেন, জ্বী।
আলহামদুল্লিাহ। ছেলে কি করে?
ছোটখাট ব্যবসা আছে। মুগদা পাড়ায় নিজের বাড়ি আছে।
বয়স কত?
বয়স সামান্য বেশি।
অনুমান কত।
সঠিক জানি না, ত্রিশ বত্রিশ হতে পারে, কিছু বেশিও হতে পারে। পুরুষ মানুষের বয়স কোন ব্যাপার না।
গাধার মত কথা কচ ক্যান। পুরুষ মানুষের বয়স কোন ব্যাপার না তরে কে শিখাইছে? মেয়েটা ভাল লেখাপড়া করতেছে। তারে ঘাটের মরার সাথে বিয়া দিবি? তুই তিনবারে মেট্রিক পাস করছস। তোর মেয়ে মেট্রিকে বৃত্তি পাইছে। আমরার পরিবার থাইক্যা একটা মেয়ে এমএ পাস করব। এইটা দেখনের জন্যে এখনো বাঁইচ্যা আছি। বুঝছস?
লেখাপড়াতো বিয়ের পরেও হয়।
বিয়ার পর প্রত্যেক বছরে একটা কইরা বাচ্চা হয়। আর কিছু হয় না। তুইতো আইএ পাস বউ বিয়া করছিলি। বিয়ার পরে হে কি বিএ পাস দিছে? আমারে চেতাইস না। খবর্দার কইলাম। খবর্দার।
.
বিয়ে হয়নি। এবং খুবই আশ্চর্যের ব্যাপার বীর্ন ইউনিভার্সিটির ভর্তি পরীক্ষায় পাস করে গেল। তার দাদীজান তাকে সেদিন দুহাজার টাকা দিয়ে বললেন, যা–ভাল ভাল জামা কাপড় কিন্যা আন। যেটা পছন্দ সেটা কিনবি। আইজ-কাইলের মেয়েরা যেগুলি পরে। বুজচস?
বীনু দুটো সালোয়ার কামিজ কিনেছে। নিজে একা একা গিয়েই কিনেছে। একটা শাদার উপর গোলাপী কাজ, অন্যটা লালের উপর লাল সূতার কাজ। কামিজ দুটোর কোনটাই সে পরতে পারেনি। ইউনিভার্সিটিতে যাবার প্রথম দিন সে লাল কামিজটা পরল। বীনুর মা বললেন, প্রথম ইউনিভার্সিটিতে যাচ্ছিস তোর বাবাকে সালাম করে তার দোয়া নিয়ে যা। বীনু তার বাবাকে সালাম করল। ইদ্রিস সাহেব বললেন, প্রথম ক্লাসতো এগারোটায়, এখন বাজে নটা চল্লিশ। এখন কোথায় যাচ্ছিস। বীনুর মা বললেন, প্রথম দিন একটু আগে আগে যাবে। কোন রুমে ক্লাস খুঁজে পাবে না।
ইদ্রিস সাহেব বললেন, খুঁজে না পাওয়ার কি আছে? তাছাড়া আমিতো সঙ্গে যাচ্ছি।
বীনুর মুখ শুকিয়ে গেল। বাবা সঙ্গে যাবেন। তার সঙ্গে ক্লাস রুম খুঁজে বের করবেন। কে জানে ক্লাস চলাকালীন সময়ে হয়তো বারান্দায় দাঁড়িয়ে থাকবেন। সবাই। হাসাহাসি করবে।
ইদ্রিস সাহেব বীনুর শুকনো মুখের দিকে তাকিয়ে নির্বিকার ভঙ্গিতে বললেন, তুই অপেক্ষা কর। আমার সামনে দাঁড়িয়ে থাকিস না। সামনে থেকে যা। বলেই কঠিন গলায় ডাকলেন, সুরমা-সুরমা।
সুরমা মাছ কাটছিলেন, হাতে মাছের রক্ত নিয়েই ছুটে গেলেন। ইদ্রিস সাহেব থমথমে গলায় বললেন, মেয়ে যে জামাটা পরেছে সেই জামাটা দেখেছ? গলার কাটা কত বড় দেখেছ?
সুরমা ক্ষীণ গলায় বললেন, আজকালতো সবাই এইসবই পরে।
ইদ্রিস সাহেব বললেন, ন্যুড ক্লাবে আজকালতো অনেকে ন্যাংটাও ঘুরে বেড়ায়। তোমার মেয়েতো পড়াশোনা করার জন্যে যাচ্ছে। সেকি তার বুক দেখানোর জন্যে যাচ্ছে? সে দেখাতে চায় যে তার বুক বড়?
ইদ্রিস সাহেব কথাগুলো চাপা গলায় বললেও বিনু বারান্দা থেকে শুনে ফেলল। তার ইচ্ছা করল ছাদ থেকে লাফ দিয়ে নিচে পড়ে যায়। সে লাফ দিয়ে পড়ল না। যথাসময়ে সাধারণ একটা শাড়ি পড়ে বাবার সঙ্গে রিকশা করে রওনা হল। রিকশায় ইদ্রিস সাহেব মেয়েকে কয়েকটা উপদেশ দিলেন। কখনো কোন ছেলের সঙ্গে কথা বলবে না। মেয়েদের সঙ্গে মেশার ব্যাপারেও সাবধান। বেশি মেশামেশিরও দরকার নেই। ইউনিভার্সিটি কোন আড্ডাখানা না। ক্লাস করবে, ক্লাস শেষ হবে বাসায় চলে আসবে। ব্যাস।
কোন পরিবেশে বীনু বড় হচ্ছে তা মনিকা বা মনিকার বান্ধবীরা জানে না। জানলে বুঝতো একটা বদ ছেলে তার গায়ে হাত দেয়ার পরেও সে কেন বলছে–কেউ গায়ে হাত দেয়নি। এই নিয়ে কোন সমস্যা হলে বাবার কানে চলে যাবে। বাবা সঙ্গে সঙ্গে বলবেন, যথেষ্ট হয়েছে আর না। পড়াশোনার দরকার নেই। বিয়ে দিয়ে ঝামেলা মিটাও। কবুল কবুল কবুল–ঝামেলা শেষ।