বন্ধুর বাসায় দাওয়াত ছিল।
খাওয়া-দাওয়া ঠিকমত করেছিস?
জ্বি।
কি খাওয়ালো?
পোলাও আর খাসির রেজালা।
বোরহানি ছিল না?
জ্বি না।
গরমের মধ্যে বোরহানি দেয়া তো উচিত ছিল। রিচ ফুড বোরহানি ছাড়া হজম হবার কথা না। খাওয়া-দাওয়ার পর মিষ্টি পান খাস নাই?
জ্বি খেয়েছি।
সিগারেট খাস নাই? মিষ্টি পানের সাথে তো সবাই সিগারেট খায়। তুই খাস নাই?
জ্বি না।
আমিতো গন্ধ পাচ্ছি। দেখি হা করতো, বড় করে হা কর। আরো বড়। এখন নিঃশ্বাস ফেল।
জহির নিঃশ্বাস ফেলল এবং কাঁদো কাঁদো গলায় বলল, আর কোনদিন খাব না বাবা। ইদ্রিস সাহেব মধুর গলায় বললেন–খাবি না কেন, অবশ্যই খাবি। বন্ধুবান্ধব আগ্রহ করে দেয়, না খেলে ওরা মনে কষ্ট পাবে। কারো মনে কষ্ট দেয়া ঠিক না। আচ্ছা এখন নাম বিছানা থেকে।
জহির বিছানা থেকে কাঁপতে কাঁপতে নামলো।
সার্ট গায়ে দে।
জহির সার্ট গায়ে দিল।
ইদ্রিস সাহেব বললেন, যা এখন বাসা থেকে চলে যা। তোকে আর পুষব না। তুই আমাকে বাপ ডাকবি তার জন্যে তোকে পোষার দরকার দেখি না। ঢাকা শহরে শত শত লোক আছে যাদের তিনবেলা ভাত খাওয়ালে খুশি মনে আমাকে বাপ ডাকবে।
.
জহিরকে অবশ্যই সে রাতে বাসা ছাড়তে হত যদি না ইদ্রিস সাহেবের মা ভাগ্যক্রমে বাসায় থাকতেন। এই ভদ্রমহিলার বয়স সত্তরের উপর। চোখে দেখতে পান না। কিন্তু কান খুব পরিষ্কার। হাঁটা চলা করতে পারেন। হৈ চৈ শুনে তিনি দেয়াল ধরে ধরে বের হয়ে এলেন এবং তীক্ষ্ণ গলায় বললেন, আবু কি হইছে?
ইদ্রিস সাহেব বললেন, কিছু না মা, ঘুমান।
বাসাত থাইক্যা কারে বাইর করতাছস?
আম্মা আপনে ঘুমান।
আমি জীবিত থাকতে তুই আমার নাতিরে রাস্তায় বাইর কইরা দিবি, তোর সাহসতো কম না। সাহস বেশি হইছে?
কাউরে বাইর করতেছি না।
এইটা ভাল কথা।
থুরথুরি বুড়ি বিছানায় শুতে গেলেন। তবে বিছানায় শুয়ে শুয়ে সারাক্ষণই কথা বলতে লাগলেন–সিগারেট খাইছে তো কি হইছে? তার বয়সে তুই বিড়ি খাইচস। নিজের বাপের মাইর তোর মনে নাই। বাপগিরি ফলাস। অত বাপগিরি ভাল না।
.
বীনুর ভরসা তার দাদীজান। দাদীজান এখন তাদের বাসায় আছেন। তিনি পালা করে তার চার ছেলের বাসায় তিন মাস করে থাকেন। রোজার ঈদ পর্যন্ত বীনুদের সঙ্গে থাকার তারিখ পড়েছে। দাদীজানকে দিয়ে বাবার অনুমতি বের করে নেয়া খুব সমস্যা হবে না বলেই বীনুর ধারণা। বীনুর খুব শখ মনিকার সঙ্গে একটা রাত কাটায়। এত সুন্দর একটা মেয়ে আর এত বড়লোক। ওদের বাড়িটাও নিশ্চয়ই দেখার মত হবে। বীণুর ক্ষীণ আশা একটা রাত থাকলে মনিকার সঙ্গে তার ভাব হতে পারে। এরকম। একটা মেয়ের সঙ্গে ভাব হওয়াও ভাগ্যের কথা। মনিকা যাদের সঙ্গে ঘুরে বীনু দূর থেকে তাদের দেখে, তাদের চালচলন কথাবার্তা সবই অন্য রকম। সেদিন মনিকারা চারজন (ওরা চারজন সব সময় এক সঙ্গে থাকে। সেই জন্যে ওদের নাম হয়েছে চতুর্ভুজ)। ওয়াদুদ স্যারের ঘরে ঢুকে পড়ল। মনিকা তখন স্যারের রুমে। সে গেছে তার। পার্সেন্টেজ দিতে। দেরিতে ক্লাসে এসেছিল বলে পার্সেন্টেজ দিতে পারেনি।
ওয়াদুদ স্যার বললেন, কি ব্যাপার, চতুর্ভুজ এক সঙ্গে? মনিকা হাসি মুখে বলল, আপনি স্যার কফি বানিয়ে খান। রোজ এত সুন্দর গন্ধ পাই। আজ আমাদের কফি খাওয়াতে হবে।
বেশতো, কফি খাও।
ওয়াদুদ স্যার বেয়ারাকে কফি বানাতে বললেন। বীনু মুগ্ধ হয়ে গেল মেয়ে চারটার সাহস দেখে।
আরেকবার বীনু সাবসিডিয়ারী ক্লাসের শেষে বেরুচ্ছে। একটা বদ ছেলে ভিড়ের অজুহাতের সুযোগে বীনুর বুকে হাত দিল। বীনু লজ্জা এবং ভয়ে প্রায় জমে গেল। মনিকা ছিল তার পেছনে। সে ছেলেটার সার্ট খামছে ধরে বলল, তুমি ওর গায়ে হাত দিলে কেন? চারদিকে ভিড় জমে গেল। বীনু প্রায় কাঁদো কাঁদো গলায় বলল, কেউ আমার গায়ে হাত দেয়নি। মনিকা, ওকে ছেড়ে দাও।
মনিকা শীতল চোখে কিছুক্ষণ বীনুর দিকে তাকিয়ে থেকে ছেলেটাকে ছেড়ে দিল। মনে মনে সে নিশ্চয়ই বীনুর মুখে থু থু দিয়েছে। বীনুর দিকে তাকাতেও নিশ্চয়ই তার
ঘেন্না করছিল। করাটা স্বাভাবিক। বীনু যদি তার অবস্থাটা ব্যাখ্যা করতে পারতো তাহলে হয়তো মনিকা তাকে এতটা ঘৃণা করতো না। তাদের বাসা অন্য সব বাসার মত না। তার বাবা-মা অন্য সব বাবা-মা’র মত না। তারা আলাদা। কি রকম যে আলাদা তা মনিকা বা মনিকার মত বান্ধবীরা জানে না।
.
বীনু যখন কলেজে পড়ে তখন হঠাৎ দেখা গেল একটা ছেলে প্রায়ই তাদের বাসার। সামনে হাটাহাটি করে। জানালার দিকে তাকিয়ে সিগারেট ফুকে। বীনু ব্যাপারটা শুরুতে লক্ষ্যই করেনি। লক্ষ্য করলেন বীনুর মা। তিনি সঙ্গে সঙ্গে বীনুর বাবাকে জানালেন। ইদ্রিস আলী ঐ ছেলেকে কিছু বললেন না। তিনি ঝিম ধরে সারা দুপুর বসে রইলেন (অফিসে গেলেন না, অফিস কামাই করলেন)। মাগরেবের নামাজের পর মিষ্টি গলায় ডাকলেন–বীনু কইরে?
বীনু সামনে এসে দাঁড়াল।
বাসার সামনে ঘুরাঘুরি করে ছেলেটা কে?
বীনু অবাক এবং খানিকটা ভীত গলায় বলল, কোন ছেলে?
ইদ্রিস সাহেব আরো শান্ত গলায় বললেন, কোকরা চুলের একটা ছেলে, গলাটা লম্বা।
জানি নাতো বাবা।
জান না?
জ্বি না।
তুমি বলতে চাচ্ছ তুমি তাকে চেন না জান না, এম্নি সে তোমার ঘরের সামনে ঘুরাঘুরি করে?
বীনু এই পর্যায়ে ভয়ে অস্থির হল। কারণ দাদীজান বাসায় নেই। তিনি তাঁর ছোট ছেলের বাসায়। জুলাই মাস পর্যন্ত সেখানে থাকবেন। বীনুকে রক্ষা করার এখন আর কেউ নেই।