গত সোমবারে রহমানিয়া হোটেলের সামনে দাঁড়িয়ে সে সিগারেট টানছিল। হঠাৎ দেখে আবদুল করিম বাজার করে ফিরছে। দেখামাত্র সে হাতের সিগারেট ফেলে দিল। কি কাণ্ড! নিজের ছোট ভাই। তাকে দেখে সে সিগারেট ফেলবে কেন? ভাগ্যিস আবদুল করিম ব্যাপারটা দেখেনি। দেখলে একটা লজ্জার ব্যাপার হত।
দীর্ঘদিন চাকরি-বাকরি না থাকলে মন ছোট হয়ে যায়। তখন মানুষ ছোট ভাইকে দেখে সিগারেট ফেলে দেয়ার মত কাণ্ড-কারখানা করে বসে। তার মন যে ছোট হয়ে গেছে এটা মোবারক জানে। কিছুটা ছোট হয়ে থেমে গেলে হত। থামছে না। যতই দিন যাচ্ছে ততই ছোট হচ্ছে। বিশ্রী ব্যাপার। আবদুল করিমকে দেখলে ইদানীং তার কেমন জানি ভয় ভয় করে। চোখের উপর চোখ পড়লে নিজের অজান্তেই চোখ নামিয়ে নেয়। অবশ্যি আবদুল করিমের কথা-বার্তার ধরনও এখন বদলে গেছে। আগে গলার স্বর চিকন ছিল, এখন মোটা হয়ে গেছে। কথা বলার সময় ভুল তালে পা নাচায়। কিছুদিন হল চোখে আবার চশমা পরেছে। মোবারকের ধারণা, এইসব হয়েছে বিয়ের কারণে। বিয়ে করলে পুরুষমানুষ বদলাবেই। তার উপর বউ যদি সুন্দরী হয় তাহলে তো কথাই নেই। নতুন বিয়ে করা পুরুষদের প্রধান কাজই হল বউকে দেখানো যে সে একটা বিরাট কিছু। কাজেই যে পুরুষের গলা চিকন সে অনেক কষ্ট করে মোটা গলায় কথা বলে। আশপাশের সবার দিকে এমন করে তাকায় যেন তারা কেউ মানুষ না, সে একাই মানুষ। শুধু মানুষ না, জ্ঞানী মানুষ।
সেদিন খাবার টেবিলে বসে আবদুল করিম জ্ঞানীদের মত কথা বলল। প্রথম কিছুক্ষণ পা নাচাল। প্রথমে ডান পা, তারপর বাঁ পা, তারপর দু’টাই একসঙ্গে। পা নাচানোর পর গলা খাঁকারি দিল। গলা পরিষ্কার করে নিল। অপরিষ্কার গলায় তো আর জ্ঞানের কথা বলা যায় না। গলা পরিষ্কার হবার পর বলল, লতু চশমটা দেখি। আদর করে লতিফাকে লতু ডাকা। স্ত্রীকে আদর করে ডাকবে না তো কাকে ডাকবে? লতু ফতু যা ইচ্ছা ডাকুক, কিন্তু বড় ভাইয়ের সামনে ডাকবে কেন? আদব-কায়দার একটা ব্যাপার আছে না? তাছাড়া স্ত্রীর সামনে যে ভঙ্গিতে সে কথা বলছে সেটা তো আদবের বড় খেলাফ। চশমা চোখে দিয়ে চশমা’র ফাঁক দিয়ে তাকিয়ে কথা বলা। আরে ব্যাটা, তুই কি কলেজের প্রিন্সিপ্যাল নাকি? তুই হলি সাবরেজিস্টার অফিসের কেরানী। চশমা’র ফাঁক দিয়ে তোর কথা বলার দরকার কি? আর গলা মোটা করারও-বা দরকার কি? তোর যেমন গলা তুই তেমন গলায় কথা বলবি। এরকম মোটা গলায় বেশিদিন কথা। বললে তো গলায় ক্যানসার-ফ্যানসার হবে। মোবারক অবশ্যি ভাইয়ের সব কথা মাথা নিচু করে শুনল।
ভাইজান, আর কতদিন এই ভাবে বসে বসে থাকবেন? কিছু একটা করা দরকার?
মোবারক বলল, হুঁ।
তিনটা আঙুল কাটা গেছে, তার জন্যে তো আপনি অচল হয়ে পড়েননি। হাত নেই এমন মানুষও কাজ করে খাচ্ছে।
মোবারক মনে মনে বলল, ভিক্ষা করে খাচ্ছে। তুই কি তাই চাস? তোর বড় ভাই ভিক্ষা করলে তোর মান থাকবে?
বেঙ্গল টুলস যে আপনাকে দশ হাজার টাকা কমপেনসেশান দিবে বলেছিল, তার কি হল? সেই টাকাটা পেলেও তো একটা ব্যবসা-ট্যবসা শুরু করতে পারতেন। ওরা টাকাটা কবে দেবে কিছু বলেছে?
দিন-তারিখ কিছু বলে নাই।
দিবে তো? নাকি দিবে না?
দিবে।
গা ছেড়ে বসে থাকলে কি আর দিবে? ওদের তাগদা দিতে হবে। রোজ গিয়ে বসে থাকতে হবে। দিন-রাত ঘরে বসে থাকায় কোন লাভ নাই। লতু, পান দাও তো।
লতিফা পান আনতে যাচ্ছে এই ফাঁকে মোবারক উঠে পড়ল। পান খাওয়ার সময় সে সামনে থাকতে চায় না। তখন আবদুল করিম একটা বিশ্রী ব্যাপার করে। সেই বিশ্রী ব্যাপার দেখতে খারাপ লাগে। লতিফা যখন পান এনে দেয় তখন গদগদ ভঙ্গি করে আবদুল করিম হা করে। আবদুল করিমের মুখ ছোট, কিন্তু মুখের কাটা বিরাট বড়। হা করা মুখ বড় বিশ্রী দেখায়। লতিফাকে সেই হা করা মুখে পান ঢুকিয়ে দিতে হয়। এই। ব্যাপারগুলি আগে সে আড়ালে করত। ইদানীং মোবারকের সামনেই করছে। মোবারকের ধারণা, আজকাল তাকে তার ছোট ভাই মানুষ হিসেবেই গণ্য করছে না। কুকুর-বিড়াল ভাবছে। কুকুর-বিড়ালের সামনে মানুষ লজ্জা করে না। আবদুল করিমই বা কেন করবে?
ভাইজান, আপনি টাকাটা উদ্ধার করার চেষ্টা করেন।
আচ্ছা।
টাকাটা পেলে আমিও কিছু দিব। দু’টা মিলায়ে একটা দোকান-টোকান দেন। আপনার বয়সও তো কম হয় নাই। থিতি হয়ে ঘর সংসার করতে হবে না।
মোবারক মনে মনে বলল, চুপ থাক হারামজাদা। বক্তৃতা দিস না। বসে বসে পান খা। পা নাচা।
পান চলে এসেছে। আবদুল করিম চোখ বন্ধ করে হা করল। লতিফা মুখে পান ঢুকিয়ে দিল। পান খেতে খেতে বলল, বুঝলেন ভাইজান, আপনার যদি মেট্রিকটাও পাশ থাকত আমাদের অফিসে একটা ব্যবস্থা করে দিতাম। অফিসে এই জুনে লোক নিচ্ছে। আমাদের সাবরেজিস্ট্রার সাহেব বলতে গেলে আমার কথায় উঠেন বসেন। মুন্সিগঞ্জ বাড়ি। অতি অমায়িক।
মোবারক বুঝতে পারে সবই বউকে শোনানোর জন্যে চাল দেয়া কথা। কতবড় লায়েক হয়ে গেছে! মুখের কথায় চাকরি হয়ে যায়! সাবরেজিস্ট্রার তার কথায় উঠে বসে। সাবরেজিস্ট্রারের তো খেয়ে-দেয়ে কাজ নেই। কেরানীর কথায় উঠ-বোস করাই। একমাত্র কাজ। তুই হলি ড্রিল মাস্টার, তোর কথায় উঠ-বোস করবে? ফাজিলের ফাজিল।
ভাইজান, আপনি বেঙ্গল টুলসকে চাপ দিয়ে ধরবেন। কমপেনসেশান দেবে না মানে? তার বাপ দেবে। তেমন ঝামেলা করলে আমার লোক আছে, মেরে তক্তা বানিয়ে দেবে। শুধু তক্তা না, প্রয়োজনে তক্তায় বানিশ দিয়ে দেবে। হা হা হা।