মতি হাত বাড়িয়ে দিল। জয়গুন স্বামীর হাতের লোম খাড়া হয়েছে কি না তা দেখতে হাত বাড়ালো না। সে ঘুমিয়ে পড়েছে। তার বড় বড় নিঃশ্বাস পড়ছে। মতি এবার কাশির বেগ সামলাতে পারল না। প্রবল বেগে কাশতে থাকলো। জয়গুনের ঘুম ভাঙল না। ঘুম ভাঙলো মোহম্মদ মনোয়ার হোসেনের। সে কাঁদতে শুরু করলো। মতি উঠে এসে ছেলেকে কোলে তুলে নিল। আশ্চর্য কাণ্ড! কোলে উঠেই ছেলে শান্ত। চোখ বড় বড় করে তাকাচ্ছে। মতি বলল, নটি বয়। নটি বয়। আরে, ব্যাটা দেখি হাসার চেষ্টা করে।
মতি ছেলেকে কোলে নিয়ে বসলো। ছেলে যেন কেঁদে মা’র ঘুম না ভাঙায় এই জন্যেই ছেলের সঙ্গে গল্প শুরু করলো। গল্প কিছু বুঝবে না। শব্দ শুনবে, ঠোঁট নাড়া দেখবে। এতে মজা পেয়ে কান্না ভুলে থাকবে।
ব্যাটা শোন, সংগ্রামের সময়ের কথা শোন। কইলজা ঠান্ডা হইয়া যাইব অমন অবস্থা…প্রথম যুদ্ধ করলাম বোয়ালখালি বাজারে। সংবাদ আসছে চাইর-পাঁচজন রাজাকার আসছে বোয়ালখালি বাজারে। কুদ্দুসের পাট গুদামে থাকে। মদ, গাঁজা খায় আর পাবিলিকরে খুব অত্যাচার করে। আমরা দশজন নৌকা নিয়া রওনা হইলাম। আমরার কমান্ডার হইলেন মনু ভাই। ইউনির্ভাসিটির ছাত্র। কি সুন্দর চেহারা। কি ভদ্র ব্যবহার। শিক্ষার গুণ, আর কিছু না। আসছেও খুব বড় পরিবার থাইক্যা। যাই হোক, ঘটনা শোন। সইন্ধ্যাকালে বোয়ালখালি বাজারে নাইম্যা পাট গুদামের তিনদিকে পজিশান নিলাম। রাজাকার ভাইব্যা গুলি শুরু করছি। রাজাকারের মজা হইল—-গুলি শুনলেই এরা বন্দুক ফালাইয়া দৌড় দেয়। এইখানে দেখি ঘটনা অন্য। কথা নাই বার্তা নাই, পাট গুদামের ভিতর থাইক্যা মেশিনগানের গুলি শুরু হইল। ট্যাকট্যাক ট্যাকট্যাক ট্যাকট্যাক। মিলিটারি ছাড়া মেশিনগান পাইব কে? আমরার কইলজা গেল শুকাইয়া। মিলিটারির সাথে প্রথম যুদ্ধ।
রাইফেল হাতে কাঁপতাছি আর দোয়া ইউনুস পড়তাছি–তখন ডাইন পায়ে গুলি খাইলাম। আমার দুনিয়া আন্ধাইর হইয়া গেল। বুঝলি ব্যাটা, তখন মনু ভাই কি করল শুন–এই আমারে পিঠের মইদ্যে নিয়া মনু ভাই পাক্কা তিন মাইল দৌড়াইল। আমার জীবন রক্ষা হইল। মনু ভাই আমারে ফালাইয়া চইল্যা আসতে পারতো। তখন সবের ঘোর বিপদ। ফালাইয়া আসে নাই। মনু ভাইয়ের ঋণ শোধ করতে পারি নাই। এর একমাস পরে মুরাদখালি ফাইটে মনু ভাই মারা গেলেন। মনে হইলেই কইলজা কামড়ায়। বুঝলিরে ব্যাটা, মনু ভাইয়ের নামে তোর নাম রাখছি। মোহম্মদ মনোয়ার হোসেন। নামের ইজ্জত রাখন চাইরে ব্যাটা। নামের ইজ্জত রাখন চাই। বড়ই ইজ্জতদার নাম।
.
গল্প বলতে বলতে মতি মিয়ার চোখ জলে ভর্তি হয়ে আসে। চোখ ভর্তি অশ্রুর কারণেই বোধহয় শিশু পুত্রটিকে তার অন্যরকম মনে হয়। তার বড় মায়া লাগে।
মতি মিয়ার শিশুপুত্র চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে থাকে। মনে হয় বাবার গল্পটা সে বুঝতে পারছে।
জলকন্যা
রাত আটটার দিকে বীনুর মনে হল সে একটা ভুল করেছে। ছোটখাটো ভুল না, বড় ধরনের ভুল–-মনিকার জন্মদিনে তার আসা ঠিক হয়নি। মনিকা তার এমন কেউ না যে তার জন্মদিনে আসতেই হবে। তাছাড়া মনিকা তাকে সেভাবে দাওয়াতও করেনি। ভদ্রতা করে বলেছে। মনিকা তার জন্মদিনের কথা নীতুকে বলছিল, সেই সময় বীনুর দিকে তাকিয়ে বলল, বীনু তুমিও এসো। বীনু তৎক্ষণাৎ হ্যাংলার মত বলেছে—আচ্ছা। এটা যে নিতান্তই কথার কথা তাও বুঝেনি।
মনিকা বলেছে, পার্টিতে যারা আসবে তাদের কিন্তু সারারাত থাকতে হবে। সারারাত আমরা হৈ চৈ করব। তোমার কোন অসুবিধা হবে না তো?
বীনু বলল, না, অসুবিধা হবে না।
অথচ তার ভয়ঙ্কর অসুবিধা হবে। তাদের বাসা এরকম না যে ঊনিশ বছর বয়েসী মেয়েকে রাতে অন্য বাড়িতে থাকতে দেবে। তার নামে বাসায় কোন চিঠিপত্র এলে তার হাতে দেয়া হয় না, আগে বীনুর মা মনোয়ারা খুলে পড়েন। পড়ার পর যদি মনে হয় সাধারণ চিঠি তবেই তার হাতে দেয়া হয়। সাধারণ চিঠিতেও সমস্যা আছে। তার এক বান্ধবী সুরমা, ক্লাস টেনে পড়ার সময়ই বিয়ে হয়ে গিয়েছিল, সে তার স্বামীর সঙ্গে চলে গিয়েছিল সেতাবগঞ্জ নামের একটা জায়গায়। সেখান থেকে সে মাসে দু’টা তিনটা করে চিঠি লিখতো। মনোয়ারা একদিন বললেন, মেয়েটা এত চিঠি লেখে কেন? ঘন ঘন চিঠি লেখার দরকার কি?
বীনু অবাক হয়ে বলল, চিঠি লিখলে অসুবিধা কি মা?
মনোয়ারা থমথমে গলায় বললেন, অসুবিধা আছে, তোর বাবা রাগ হয়। বাবা রাগ হয়–এর উপর কথা চলে না। বীনুদের সংসার তার বাবা ইদ্রিস আলির চোখের ইশারায় চলে। ইদ্রিস আলি ব্যাংকের ক্যাশিয়ার। রোগা পটকা মানুষ, থুতনীতে ত্রিশ থেকে পঁয়ত্রিশটার মত দাড়ি আছে। নিতান্তই সাধারণ চেহারার একজন মানুষ। অথচ সেই সাধারণ চেহারার মানুষের চোখের ইশারার বাইরে যাবার সাহস কারো নেই। বীনুর ছোট ভাই জহির কলেজে ভর্তি হবার পর একবার সাহস দেখালো, বাসায় ফিরল রাত সাড়ে এগারোটায়। তার এক বন্ধুর বাসায় নাকি দাওয়াত ছিল। বাসায় ফিরেই সে নিজের ঘরে ঢুকে তাড়াহুড়া করে বাতি নিভিয়ে শুয়ে পড়ল। তখন ইদ্রিস সাহেব ছেলের ঘরে ঢুকে বাতি জ্বালালেন। কোমল গলায় বললেন, জহির ওঠ (ইদ্রিস সাহেবের গলার স্বর খুবই কোমল)। জহির ধড়মড় করে উঠে বসলো। জহির সাহেব বললেন, কোথায় ছিলি?