মতি মনে মনে কয়েকবারই বলল, মাশাল্লাহ।
মোহম্মদ মনোয়ার হোসেনের দুধ খাওয়া শেষ হয়েছে। জয়গুন ছেলেকে পাশ ফিরিয়ে পিঠে চাপড় দিচ্ছে ঘুম পাড়ানোর জন্যে। চাপড়টা অনেক জোরে হচ্ছে বলে মতির ধারণা। ব্যথা পাচ্ছে হয়তো। অবোধ শিশু ব্যথার কথা বলতে পারছে না।
মতি বলল, কেঁথাটা ভিজা কিনা দেখ দেখি।
ভিজা না।
আহা হাত দিয়া দেখ না। এরা দুধের শিশু। মিনিটে মিনিটে এরার কেঁথা পরীক্ষা করা দরকার। একবার ঠান্ডা লাগলো কি, বুকে কফ বইস্যা দম শেষ।
আবার মরণের কথা? আইচ্ছা, আফনের মাথাটা কি খারাপ? তওবা করেন।
মতি মনে মনে তওবা করলো। জয়গুন ছেলের গায়ে থুক দিল। এতেও অনেক দোষ কাটা যায়। মতি বালিশের নিচ থেকে বিড়ির প্যাকেট বের করে বিছানা থেকে নামলো। পর পর দুবার ছেলের মৃত্যু সংক্রান্ত কথা বলে তার মনটা খুবই খারাপ হয়েছে। বিড়ি ধরিয়ে মন খারাপ ভাবটা একটু যদি কাটানো যায়। বারান্দায় বসে বিড়িতে টান দিতেই কাশি শুরু হল। ভয়াবহ কাশি। ফুসফুস বের হয়ে আসতে চায়। এমন অবস্থা। কাশির শব্দে মোহম্মদ মনোয়ার হোসেন আবার চিৎকার করে কাঁদতে শুরু করলো। জয়গুন না না কাঁদে না, কাঁদে না, বলে পুত্রের কান্না থামানোর চেষ্টা করছে। থামাতে পারছে না। মতি বিড়ি হাতে দূরে সরে গেল। হাতের বিড়িটা ফেলে দিতে ইচ্ছা করছে না। পয়সার কেনা জিনিস ফেলতে মায়া লাগে। বিড়ি শেষ করে মতি ফিরে এলো।
মোহম্মদ মনোয়ার হোসেন ঘুমিয়ে পড়েছে। জয়গুনও ঘুমুবার আয়োজন করছে। স্বামীকে ফিরতে দেখে সে ক্লান্ত গলায় বলল, আফনে কাশির একটা চিকিৎসা করেন। যে কাশি হইছে, শুনলে ডর লাগে।
কাশির চিকিৎসার কথা যে মতি ভাবছে না তা না–ভাবছে। টাকা-পয়সার কথা চিন্তা করেই সময় নিচ্ছে। সংসারে শিশু এসেছে। তার কত খরচা আছে। এখন আর হুটহাট করে টাকা খরচ করা যায় না। সে কতই বা আর পায়? ইসমাইল কন্ট্রাক্টর সাহেবের সঙ্গে সে আছে গত দশ বছর ধরে। দশ বছরে ইসমাইল কন্ট্রাক্টার নেত্রকোনার বড় ধনী হয়েছে। আর মতি আগে যা ছিল এখনও তাই আছে–লেবার সর্দার। রোজ হিসাবে বেতন। কিছু টাকা জমেছিল। মনোয়ার হোসেনের জন্মের সময় ডাক্তার-হাসপাতাল করে সব শেষ। জমা কিছু টাকা ছিল বলে রক্ষা। টাকা না থাকলে সর্বনাশ হয়ে যেত। শেষ বয়সে সন্তান হওয়া যে এমন জটিল, কে জানত। মতি ধরেই নিয়েছিল তাদের ছেলেপুলে হবে না। আল্লাহ পাকের কি কুদরত। তার পঞ্চাশ বছর বয়সে পুত্র সন্তান।
জয়গুন ঘুমাইছ?
না।
তোমার ছেলে কার মত হইছে বল দেখি।
জয়গুন হাই তুলতে তুলতে বলল, আফনের মত হইছে। এইটা বলাবলির কিছু। তয় স্বভাবচরিত্র কেমন হয় এইটা হইল কথা।
ইনশাল্লাহ ভাল হইব। স্বভাবচরিত্র নিয়া চিন্তা করবা না।
জয়গুন ক্লান্ত গলায় বলল, রাইত মেলা হইছে, অখন ঘুমান।
মতির ঘুম আসছে না। গল্প-গুজব করতে ইচ্ছে করছে। ছেলের জন্মের পর থেকে জয়গুনের সঙ্গে তাঁর গল্পই হয় না। জয়গুন এত ক্লান্ত থাকে। সে নিজেও অবশ্যি খুব ব্যস্ত থাকে। সকাল সাতটার সময় কাজে চলে যায়। ঘরে ফিরতে কোন দিন রাত দশটা বাজে, কোন দিন বাজে এগারোটা। কাজে যাবার সময় দেখে ছেলে ঘুমুচ্ছে, ফিরে এসেও দেখে ঘুমুচ্ছে। জয়গুন অবশ্যি ঘুম ঘুম চোখে জেগে থাকে। তাকে চারটা ভাত বেড়ে দিয়ে ছেলের কাছে চলে যায়। মতির খুব ইচ্ছা করে স্ত্রীর সঙ্গে গল্প করতে। সগ্রামের সময়ের গল্প। পনেরো বছর আগের কথা মনে হয় গতকালের ঘটনা।
মতির আবার কাশির বেগ আসছে। বহু কষ্টে সে কাশির প্রবল ঝাপটা গলা খাকারিতে এনে সামাল দিল। নরম স্বরে ডাকলো, ও জয়গুন। জয়গুন।
উঁ
তোমার ছেলে স্বাধীন দেশে জন্মাইছে, এইটা একটা ঘটনা। কি বল?
হুঁ।
স্বাধীন খুব সহজ ব্যাপার না।
হুঁ
ছেলে যখন সেয়ানা হইব স্বাধীন বিষয়টা কি বুঝাইয়া বলবা।
আইচ্ছা।
ছেলে যখন শুনব তার পিতা স্বাধীনের জন্যে যুদ্ধ করছে তখন আনন্দ পাবে। বড়ই আনন্দ পাবে। অহংকারও করতে পারে; যদিও অহংকার করা ঠিক না। তবে ছেলে মানুষ একটু-আধটু অহংকার করলে দোষ হয় না।
অখন ঘুমান, রাইত মেলা হইছে।
এই যে তোমার সঙ্গে গল্প করতেছি, এইটা আল্লাহর একটা নেয়ামত। বাঁচার কথা ছিল না। মুরাদখালি ফাইটে আমরা সতেরোজন ছিলাম। জীবন নিয়া ফিরছি মাত্র তিনজন। আমি, বাঁশখালির ইরতাজ ভাই আর গৌরাঙ্গ। গৌরাঙ্গের কথা মনে আছে? বিবাহের পরপর তোমারে দেখতে আসল। তোমার জন্যে একটা শাড়ি আনল। তারপর আমারে জড়াইয়া ধইরা কি কান্দন। সে কান্দে, আমি কান্দি। যুদ্ধের সময়ের বন্ধন। বড় কঠিন বন্ধন। রক্তের বন্ধনের চেয়েও কঠিন। ঘুমাইয়া পড়লা, ও জয়গুন, জয়গুন।
না ঘুমাই নাই।
মতি অত্যন্ত আগ্রহের সঙ্গে বলল, মুরাদখালি ফাইটের ঘটনাটা শোন। সে এক বিরাট হিস্টোরী।
জয়গুন ক্লান্ত গলায় বলল, অনেকবার তো শুনছি, আর কত?
এইসব ঘটনা পুরান হয় না। লক্ষ বার শোনা যায়। ভালমত জানা থাকলে তোমার জন্যে সুবিধা। ছেলেরে ঠিকঠাক বলতে পারবা।
আফনে নিজে ঠিকমত বলবেন।
নিজের কথা নিজের বলা ঠিক না। তাছাড়া বেশী দিন বাঁচব না। শরীর হইছে নষ্ট। চিকিৎসার সামর্থ্য নাই।
দেশ স্বাধীন কইরা তাইলে আফনের লাভটা হইছে কি?
এইতো একটা ভুল কথা বলো বউ। দেশ স্বাধীন কি আর কোন ব্যবসাবাণিজ্য যে লাভ-লোকসান হইব। স্বাধীন অনেক বড় ব্যাপার। স্বাধীনের কথা বলতে গিয়া এই দেখ গায়ের লোম খাড়া হইয়া গেছে। হাত দিয়া দেখ বউ।