কি সার্টিফিকেট?
নজরের বিষয়ে একটা সার্টিফিকেট।
আচ্ছা যাও, দেব সার্টিফিকেট।
ছুনুর হেঁচকির মত উঠছে। দূরে দাঁড়িয়ে তার মেয়েটা কাঁদছে। কি অদ্ভুত পরিস্থিতি। কে একজন বলল, ছুনুর তওবাটা পড়ায়ে ফেলা দরকার, অবস্থা ভাল ঠেকতেছে না।
ছুনুকে বিছানায় এনে শোয়ানোর ব্যবস্থা করে ডাক্তার আনতে লোক পাঠালাম। ছুনু চোখের ইশারায় আমাকে কাছে ডাকল। আমি মাথার কাছে গিয়ে দাঁড়াতেই ফিস ফিস করে বলল, মইরা যাব কিনা বুঝতাছি না। শ্বাসকষ্ট হইতাছে। একটা গোপন কথা আফনেরে বইল্যা যাই স্যার। না বললে অফরাধি হইয়া থাকব। আমার আসলে কোন ক্ষমতা নাই। দুষ্ট লোকে গেরাম ভর্তি। ক্ষমতা থাকলে নজর দিয়া এরারে শেষ কইরা দিতাম। যেমন ধরেন, আমরার চেয়ারম্যান গনি সাহেব। কত চেষ্টা করছি তারে নজর লাগাইতে। লাগে না।
আমি তাকিয়ে আছি। কি বলব বুঝতে পারছি না।
ছুনু শ্বাস টানতে টানতে ফিসফিস করে বলল, সার্টিফিকেটটা কিন্তু স্যার দিবেন। বাইচ্যা থাকলে কামে লাগব।
জনক
মতির সম্প্রতি কফের দোষ হয়েছে। দিনে কম থাকে, রাতে বেড়ে যায়। ঘুমের মধ্যেও বিকট শব্দে সে কাশে। কাশির জন্যে মতির নিজের ঘুমের কোন অসুবিধা হয় না, অসুবিধা হয় তার শিশুপুত্রের। শিশুপুত্রের নাম মোহাম্মদ মনোয়ার হোসেন। মোহাম্মদ মনোয়ার হোসেনের বয়স ২ মাস ১১ দিন। বাবার কাশির শব্দে সে অভ্যস্ত হয়ে ওঠেনি। যতবার মতি কাশে, ততবারই সে জেগে ওঠে কাঁদতে শুরু করে। তার শরীর অপুষ্ট কিন্তু গলায় ভাল জোর আছে। নিজের কাশির শব্দে মতির ঘুম না ভাঙলেও পুত্রের কান্নার শব্দে সে জেগে ওঠে। অত্যন্ত গম্ভীর গলায় বলে, সমস্যা কি? আঁ, সমস্যাটা কি? বউ, দেখোত কেঁথা ভিজা কি না।
মতির স্ত্রী জয়গুন মরার মত ঘুমায়। সে কিছুই দেখে না। সন্তান প্রসব করার প্রচণ্ড ধকল সে এখনো সামলে উঠতে পারেনি। ছেলে যত না ঘুমায়, জয়গুন ঘুমায় তারচেয়েও বেশি। কাজেই মতিকেই হাত বাড়িয়ে ছেলের কথা পরীক্ষা করতে হয়। না, কাঁথা শুকনাই আছে। হঠাৎ ছেলের বিকট কান্নায় মতি বড়ই বিস্মিত হয়। সে গভীর মমতায় ছেলের দিকে তাকিয়ে বলে, কিরে ব্যাটা কান্দ কেন? নটি বয়। ভেরী নটি বয়। ঘরে সারা রাতই একটা হারিকেন জ্বলে। হারিকেনের আলোতে নটি বয়ের চোখ জ্বলজ্বল করে। সে বাবার কথা শুনে কান্না বন্ধ করে ঠিকই তবে ঠোঁট বাঁকিয়ে রাখে। পুত্রের বাঁকা ঠোঁট দেখতে মতির বড়ই ভাল লাগে।
ঠোঁট বাঁকা কেনরে ব্যাটা? ক্ষুধা লাগছে? হাঙ্গার?
ছেলের সঙ্গে ইংরেজীতে দুএকটা কথা বলতে মতির ভাল লাগে। অল্প কিছু ইংরেজী কথা মতি জানে। সংগ্রামের সময় শিখেছিল। বাবার ইংরেজী শুনে ছেলের বাঁকা ঠোঁট আস্তে আস্তে ঠিক হয়। সে হাত বাড়িয়ে কি যেন খোঁজে। মাকে খোঁজে বলেই মতির ধারণা। মতি চাপা স্বরে ডাকে, জয়গুন, জয়গুন। জয়গুন ঘুমের মধ্যেই পাশ ফেরে। স্ত্রীর পাশ ফেরা দেখে মতির ভয়ে শরীর কাঁপে। বেহুঁশের মত পাশ ফেরা। কোনদিন না ছেলে চাপা পড়ে। ঘুমকাতুরে মায়ের কারণে অনেক সন্তানের মৃত্যু হয়েছে।
ও জয়গুন। জয়গুন।
কি?
উঠ দেখি। উঠ।
কি হইছে?
মতি গম্ভীর গলায় বলে, মোহম্মদ মনোয়ার হোসেনের মুখে মাই দেও। ব্যাটার বেজায় ভুখ লাগছে।
ছেলেকে ভাল নামে ডাকতেই মতির ভাল লাগে। জয়গুন মাঝে মাঝে টুনা মিয়া ডাকে। মতি বড়ই বিরক্ত হয়। সুন্দর একটা নাম থাকতে টুনা মিয়া ফুনা মিয়া আবার। কি? কিন্তু সে স্ত্রীকে কিছু বলে না। কষ্ট করে সন্তান প্রসব করেছে। সামান্য হলেও তার একটা দাবি আছে। তবে কোন একদিন বুঝিয়ে বলতে হবে।
জয়গুন। ও জয়গুন।
কি?
মনোয়ার হোসেনের ভুখ লাগছে। মুখে মাই দেও। ব্যাটা ক্ষিধার চোটে অস্থির হইছে। কাইন্দা বাড়ি ভাঙতাছে, তোমার কোন খুঁজ নাই। তুমি কেমন মাতা, বল দেখি।
জয়গুনের ঘুম ভাঙে। সে ছেলের মুখে দুধ দেয়। মোহাম্মদ মনোয়ার হোসেনের চুকচুক করে দুধ খাওয়ার দৃশ্যটা মতি মিয়া দেখতে পারে না। কারণ জয়গুন ছেলের মাথা শাড়ির আঁচলে ঢেকে দিয়েছে। মতি গজগজ করে। শাড়ি দিয়া এমন পেচাইছ ক্যান? দম-ফুটা লাইগ্যা না মরে।
জয়গুন স্বামীর কথায় অসম্ভব বিরক্ত হয়। বেআক্কেল একটা মানুষ। সে কি জানে।, মনের ভুলেও ছেলেমেয়ের মৃত্যু সংক্রান্ত কোন কথা বলা বাপমা’র জন্যে নিষেধ। কঠিন নিষেধ। জয়গুন গুজগুজ করে, ছিঃ দম ফুটা লাইগ্যা মিত্যু এইটা কেমন কথা। আল্লাহ নারাজ কথা। আল্লাহপাকের কাছে মাপ চান।
মতি লজ্জিত ও বিব্রত হয়। সে তৎক্ষণাৎ আল্লাহ পাকের কাছে মনে মনে ক্ষমা চায়।
জয়গুন।
উঁ।
দুধ খাইতেছে?
হুঁ।
তোমার বুকে দুধ আছে কেমুন?
কি সব কথা যে আফনে কন। শরমে বাঁচি না। ছিঃ!
শরমের কিছু নাই। দুধ শিশুর খাদ্য। এই নিয়া কথা বলায় কোন শরম নাই। কালা-জিরা ভর্তা বেশী কইরা খাইবা। দুধ বেশী আসবে। মায়ের দুধ ভাইটামিনে ভর্তি। প্রতি ফোঁটায় ভাইটামিন।
আইচ্ছা অখন চুপ যান। টুনি মিয়ারে ঘুমাইতে দেন।
ঘুমাইতাছে?
ঘুম ঘুম ভাব।
শাড়ির অঞ্চল সরাও, ব্যাটারে একটু দেখি।
দেখনের দরকার নাই। আফনে সইরা বসেন।
আহারে, একটু সরাও না।
জয়গুন নিতান্তই অনিচ্ছায় শাড়ির আঁচল সরালো। মোহম্মদ মনোয়ার হোসেন চোখ বড় বড় করে তাকালো তার বাবার দিকে। মতি মুগ্ধ গলায় বললো, চউখ কেমন সুন্দর দেখছ বউ? জয়গুন বিরক্ত গলায় বলল, নজর দিয়েন না। বাপমা’র নজর বেশি লাগে। মনে মনে বলেন, মাশাল্লাহ। মাশাল্লাহ বললে নজর কাটা যায়।