তুমি কি নিশ্চিত তোমার ক্ষমতা আছে?
ছুনু মিয়া প্রশ্ন শুনে হেসে ফেলল। আনন্দিত গলায় বলল, নিজের কথা নিজের মুখে বলা ঠিক না, গুনাহ হয়। আল্লাহপাক বেজার হন। দশ জনেরে জিজ্ঞেস করেন, তারা বলব। আর যদি অনুমতি দেন তা হইলে চোউক্ষের একটা খেলা দেখাইয়া দিমু।
চোখের খেলা দেখার জন্যে আমি তেমন আগ্রহ দেখালাম না। এই সব আধিভৌতিক ব্যাপারকে প্রশ্রয় যত কম দেয়া যায় ততই ভাল। পিশাচ ও ডাইনীদের যুগ পেছনে ফেলে আমরা অনেক দূর এগিয়ে গেছি। চাঁদে মানুষ পৌঁছে গেছে, কিছুদিন পর পৌঁছবে মঙ্গল গ্রহে। এইসময় চোখ লাগা নিয়ে মাথা ঘামানো শুধু হাস্যকর না, অপরাধও।
পরদিন দুপুরে ছুনুর সঙ্গে আমার আবার দেখা। গনি সাহেবকে নিয়ে বেড়াতে বের হয়েছি। হঠাৎ দেখি, খালের পাড় থেকে ছুনু কচুর লতি সংগ্রহ করছে। ছুনুর গায়ে আগের দিনের পোশাক নেই। ময়লা লুঙ্গি, খালি গা। চোখে সানগ্লাসও নেই। ছুনুর সঙ্গে বার-তের বছরের ফুটফুটে একটা মেয়ে। ছুনুর তুলনায় তার মেয়েটার পোশাক পরিপাটি। ফ্রকটা সুন্দর এবং পরিষ্কার। মাথার চুল বেণী করে বাঁধা। এই বোধহয় ছুনুর বৃত্তি পাওয়া মেয়ে। আমি বললাম, কে, ছুনু না?
ছুনু জিবে কামড় দিল, যেন হঠাৎ আমাকে দেখে লজ্জা পেয়েছে।
এই কি তোমার বৃত্তি পাওয়া মেয়ে?
ছুনু যেন আরো লজ্জা পেল। আমি মেয়েটির দিকে তাকিয়ে বললাম, নাম কি মা?
মেয়ে বিস্মিত এবং খুশি খুশি গলায় বলল, মরিয়ম।
ছুনু বলল, চাচাজানরে কদমবুসি কর মা। মুরুব্বিরে আদব করবা না এইসব আমি সহ্য করব না। মেয়ে এসে সালাম করল। আমি অবাক হয়ে দেখি, ছুনু চোখ মুছছে। কিছু জিজ্ঞেস করার আগেই ছুনু বলল, আপনের মত একজন বিশিষ্ট ব্যক্তি আমার মেয়েরে মা ডাকল, মনটার মধ্যে বড় আনন্দ হইতেছে স্যার। বড় আনন্দ। আপনার মত মানুষের দেখা পাওয়া ভাগ্যের কথা।
গনি সাহেব বিরক্ত গলায় বললেন, ঢং করিস না ছুনু। আজ তোর চশমা কই? চশমা ছাড়া ঘুরতাছস, তুই পাইছস কি?
গনি সাহেবের কথায় তার ভাবান্তর হল না। সে চোখ মুছতেই থাকল।
.
সন্ধ্যাবেলা গনি সাহেবের বাড়িতে ফেরার পথে ছোট্ট দুর্ঘটনা ঘটল। পা পিছলে ডিসট্রিক্ট বোর্ডের সড়ক থেকে নিচের খালে পড়ে গেলাম। ব্যথা ভালই পেলাম। পা মচকে গেল। দেখতে দেখতে ফুলে ঢোল। গনি সাহেব গম্ভীর গলায় বললেন, এই রকম ঘটনা যে ঘটব আগেই টের পাইছি। ছুনু যখন বলছে, আপনার মত মানুষের দেখা পাওয়া ভাগ্যের কথা তখনই বুঝছি, হইছে কাম।
আমি বললাম, গনি সাহেব, আমি নিজের কারণে ব্যথা পেয়েছি। পা পিছলে পড়ে গেছি। বেচারা ছুনুকে এর মধ্যে জড়ানো খুবই হাস্যকর হচ্ছে।
গনি সাহেব থতমত গলায় বললেন, শুকনা খটখটা রাস্তা, এর মধ্যে আপনের পা পিছলাইল, বিষয় কি? বিষয় পরিষ্কার। ছুনু হারামজাদা নজর দিছে। তার চউখে ছিল চশমা। এটা তো সোজা হিসাব। হারামজাদার সাহস কত! চশমা ছাড়া ঘুরে। এর মীমাংসা হওয়া দরকার।
অন্ধ বিশ্বাসের সঙ্গে তর্ক চলে না। কাজেই আর কিছু না বলে আমি গনি সাহেবের কাঁধে ভর দিয়ে ঘরে ফিরলাম। আমার উপর ছুনু নজর দিয়েছে এই খবর কিছুক্ষণের মধ্যে রাষ্ট্র হয়ে গেল। দলে দলে লোক আমাকে দেখতে আসতে লাগল। যেই আসে, গনি সাহেব তার কাছেই নজর লাগার প্রক্রিয়া ব্যাখ্যা করেন। আমাকে আমার ফুলে যাওয়া পা দেখাতে হয়। দর্শনার্থীরা আহা, বিদেশী মানুষটারে কি বিপদে ফেলছে বলে সমবেদনার আর্দ্র স্বর বের করে। বিশ্রী অবস্থা!
রাতে খাবার সময় গনি সাহেব আমাকে জানালেন যে, ছুনুকে পাওয়া যাচ্ছে না। সে পলাতক।
আমি বিস্মিত হয়ে বললাম, ছনু পলাতক কেন?
তার নজর লাগছে সেই খবর পাইয়া ভাগছে। ভাইগ্যা যাইব কই? ছুনুর কপালে দুঃখু আছে। বেজায় দুঃখু।
আমি হতভম্ব গলায় বললাম, মা’রধোর করা হবে নাকি?
দেখেন না কি হয়। আইজ তার বাপের নাম বিস্মরণ হবে।
আমি আপনার কাছে হাত জোড় করে বলছি ছুনুকে কিছুই বলবেন না। আমি পুরো ব্যাপারটায় খুবই লজ্জিত। আমার লজ্জা আর বাড়াবেন না।
গনি সাহেব উত্তর দিলেন না। গম্ভীর হয়ে রইলেন।
.
গ্রামের মানুষ একটা তুচ্ছ ব্যাপারকে কোন পর্যায়ে নিয়ে যেতে পারে তার প্রমাণ পেলাম শেষ রাতে। ঘুমিয়ে ছিলাম। গনি সাহেব আমাকে ঘুম থেকে তুলে বললেন, ছুনু। ধরা পড়েছে। আসেন দেখে যান। হারামজাদা কত বড় বদ! নিজের ঘরের চালের উপরে উঠে বসেছিল। তয় তার জন্মের শিক্ষা হয়ে গেছে।
আমি ঘর থেকে বের হয়ে দেখি, উঠোনের মাঝখানে ছুনু পড়ে আছে। আমাকে আসতে দেখে কে একজন পাঁচ ব্যাটারির একটা টর্চ ছুনুর উপর ধরল। আমি অবাক হয়ে দেখলাম, ছুনুর গায়ে কোন কাপড় নেই, সম্পূর্ণ নগ্ন অবস্থায় সে পড়ে আছে। সারা শরীর রক্তে মাখামাখি। সে মাঝে মাঝে শা শা জাতীয় শব্দ করছে। আবার সেই শব্দ থেমে যাচ্ছে। কি ভয়াবহ অবস্থা!
উঠোনের এক প্রান্তে দাঁড়িয়ে আছে ছুনুর মেয়েটা। সে তার বাবাকে দেখছে না, দেখছে আমাকে। তার চোখে ঘৃণা নেই, রাগ নেই, তার চোখ গভীর অভিমানে আর্দ্র।
আমি ছুনুর কাছে গিয়ে বললাম, ছুনু, আমার লজ্জা আর অনুতাপের কোন শেষ নেই। আমি তোমার কাছে ক্ষমাপ্রার্থী।
ছুনু অনেক কষ্টে চোখ মেলল। আমি তার চোখে-মুখে একটা আনন্দের আভা দেখলাম। সে ফিস ফিস করে বলল, গরীব হইয়া জন্মাইছি। মাইর তো কপালে আছেই। স্যাররে যে ক্ষমতাটা দেখাইতে পারছি এইটাই মনে শান্তি। আপনে জ্ঞানী মানুষ। আপনে যেটা বুঝবেন, অন্য দশজনে সেইটা বুঝব না। তাছাড়া আইজের ঘটনায় নাম আরো ফাটব। এইটাও তো স্যার কম কথা না। মন্দ হউক ভাল হউক একটা ক্ষমতা পাইছি। দশজনে যদি নাই জানলো, হেই ক্ষমতা দিয়া লাভ কি? আমারে একটা সার্টিফিকেট যদি লেইখ্যা দেন বড় ভাল হয়। ঘরে টানাইয়া রাখি।