মবিনের ঘর বসার ঘরের পাশে। সে বাতি জ্বালালো না। বাতি জ্বালালেই উপস্থিতি জানান দেওয়া হবে। দরকার কি? মেয়েদের বাহারী হ্যান্ডব্যাগটা সে খাটের নিচে লুকিয়ে ফেলল। ভিতরে কী আছে তা এখনি দেখার দরকার নেই। এক সময় দেখলেই হবে। কিছু না কিছু তো থাকবেই। কপাল ভালো থাকলে বেশ কিছুদিন বাবার কাছে সেলুনে চুল কাটার টাকা চাইতে হবে না। বাবা তাকে বলতে পারবেন না–শো মি সাম ফায়ার, ইয়াং ম্যান।
মবিন তার বিছানায় লম্বা হয়ে শুয়ে পড়েছে। পাশের ঘরে বাবা ছাত্রী পড়াচ্ছেন। বাবার গলার স্বর পরিষ্কার। ঝন ঝন করে বাজছে। তিনি বলছেন–শোন মীরা, এক্সপ্রেশনিস্টরা কাজ করে ডিস্টরশন আর এক্সাজারেশন নিয়ে। এক্সপ্রেশনিজম হলো জার্মানদের আন্দোলন। ফিউচারিজম হলো ফরাসীদের। বাঙালী কবিদের কেউ কেউ এক্সপ্রেশনিস্ট ধারায় কবিতা লিখেছেন। যেমন ধর আমাদের জীবনানন্দ। আট বছর আগের একদিন কবিতাটার কথা মনে আছে?
শোনা গেলো লাশ কাটা ঘরে
নিয়ে গেছে তারে
কাল রাতে ফাল্গুনের রাতের আধারে…
মোবারক হোসেন সাহেব কবিতা আবৃত্তি করে যাচ্ছেন। বাবার ছাত্রীর সঙ্গে মবিনও কবিতা শুনছে। তার কবিতা শুনতে বেশ ভালো লাগছে।
ছুনু মিয়া
আমার নাম ছুনু মিয়া–গলার স্বরে বিস্মিত হয়ে তাকালাম। চাপা হিসহিসে গলা। সর্পকূলের কথা বলার ক্ষমতা থাকলে হয়ত এভাবেই কথা বলত। তবে আমার পাশে যে দাঁড়িয়ে সে সাপ না, মানুষ। ছোটখাট একজন মানুষ। গায়ে চকচকে শার্ট। সেই শার্ট প্যান্টের ভেতর ইন করানো। পায়ে অবশ্যি স্পঞ্জের স্যান্ডেল। লক্ষ্য করলাম, পায়ের বুড়ো আঙুলে নেল পলিশ দেয়া হয়েছে। হাতের কনিষ্ঠ আঙুলেও নেল পলিশ। মাথার চুল তেলে চপচপ করছে। চোখে সানগ্লাস। কিছুক্ষণ আগে পান খেয়েছে, পানের রস গড়িয়ে পড়ছে।
আমার জন্যে এট্টু খাস দিলে দোয়া রাখবেন স্যার।
এই বলে ছুনু মিয়া আমাকে কদমবুসি করতে এগিয়ে এল। আমার পাশের চেয়ারে নীলগঞ্জ ইউনিয়নের চেয়ারম্যান গনি সাহেব বসে আছেন। তিনিও ছুনু মিয়ার মতই ছোটখাট মানুষ। তবে গলায় অসম্ভব জোর। তিনি প্রচণ্ড ধমক লাগালেন, খবর্দার উনার গায়ে হাত দিবি না। খবর্দার বললাম।
ছুনু মিয়া হেসে ফেলল। মনে হল ধমক খেয়ে সে বড়ই আনন্দ পাচ্ছে। গনি সাহেব আবারো ধমক দিলেন, দূরে গিয়া দাঁড়া ছুনু।
ছুনু একটু সরে গিয়ে তৃপ্তির হাসি হাসল। ধমক খেয়ে এত আনন্দিত হতে এর আগে কাউকে দেখিনি। সে পকেটে হাত দিয়ে রুমাল বের করে বেশ কায়দা করে মুখ মুছতে লাগল। ফুল তোলা বাহারী রুমাল। রুমালে আতর ছিল বোধহয়। চারদিক সস্তা আতরের গন্ধে ভরে গেছে।
গনি সাহেব বললেন, ছুনু, তুই দশ হাত দূরে গিয়া বস। চশমা’র ফাঁক দিয়া উনারে দেখবার চেষ্টা করবি না। চশমা’র ফাঁক দিয়া দেখনের চেষ্টা করছস কি তোরে জ্যান্ত কবর দিয়ে ফেলব। উনি অতিথ মানুষ। উনার বিপদ হইলে তোর রক্ষা নাই।
আমি এদের আচার-আচরণ, কথাবার্তা কিছুই বুঝলাম না। তবে খুব ব্যস্তও হলাম। আমি জানি, যথাসময়ে আমাকে বলা হবে। আমার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেবার জন্যেই ছুনুকে আনা হয়েছে। এখন তাকে নিয়ে খানিকটা নাটক করা হচ্ছে। গ্রামের লোকজন নাটক করতে পছন্দ করে।
গনি সাহেব আমার দিকে ঝুঁকে এসে বললেন, ছুনু মিয়ার চোখ খুবই খারাপ। চোখে নজর লাগে। তার চোখের নজর এই অঞ্চলে বিখ্যাত। এই জন্যেই কালো চশমা। ইউনিয়ন বোর্ডের খরচে চশমা কিনে দেয়া হয়েছে। তবে হারামজাদা বদের হাড্ডি। চশমা’র ফাঁক দিয়া দেখার চেষ্টা করে। একটু আগে আপনেরে দেখার চেষ্টা করতেছিল। সময়মত বুঝতে পারছি বইল্যা রক্ষা।
নজর লাগা ব্যাপারটা আমার অজানা নয়। কিন্তু এই সামান্য ব্যাপারটাতে এরা এমন বিশিষ্টতা আরোপ করবে, ইউনিয়ন বোর্ডের পয়সায় নজর লাগা ঠেকানোর জন্যে সানগ্লাস কিনে দেয়া হবে, তা ভাবিনি। সানগ্লাস পরিয়ে নজর লাগা ঠেকানো যায় তাও জানা ছিল না।
যার নজর লাগবে বলে সবাই মনে করে সে এক ধরনের হীনমন্যতায় ভুগবে এটাই স্বাভাবিক। ছুনু মিয়ার মধ্যে সেরকম কিছু দেখা গেল না, বরং তাকে তার ক্ষমতায় বেশ আনন্দিত মনে হল। এদিক-ওদিক তাকাচ্ছে। কিছুক্ষণ পর পর রুমালে মুখ মুছছে।
গনি সাহেব বললেন, এই ছুনু, স্থির হইয়া বস। অত কিসের নড়াচড়া?
ছুনু মিয়া আবারো দাঁত বের করে হাসল। সবাই তার দিকে লক্ষ্য রাখছে এটাই মনে হয় তার আনন্দের মূল কারণ। আমি তার দিকে তাকিয়ে বললাম, ছুনু নামের অর্থ কি?
ছুনু মিয়া হাসি মুখে বলল, নামের অর্থ জানি না। পিতা-মাতা নাম রাখছিল ছানোয়ার, গেরামের লোকে ডাকে ছুনু। বড় নামে ডাকতে গেরামের লোকের কষ্ট হয়। গেরামের লোকের জিহ্বা থাকে মোটা।
আমি ছুনু মিয়ার রসিকতায় অবাক হলাম। তারচেয়েও অবাক হলাম তার গলার স্বরে। আগে যেমন সাপের গলায় কথা বলছিল এখন তা বলছে না। স্বাভাবিক গলা। মনে হয় প্রথম পরিচয়ের সময় সাপের মত গলা সে ইচ্ছা করেই করে। শুরুতেই ভয় দেখানোর চেষ্টা। আমি বললাম, তোমার বয়স কত ছুনু?
ছুনু কিছু বলার আগে চেয়ারম্যান সাহেব বিরক্ত গলায় বললেন, স্যার, আপনে এরে তুমি কইরা বলতেছেন কেন? তুমি বলায় লাই পাইতেছে। এরে তুই কইরা বলেন।