দোস্ত, তোর এখানে মানিব্যাগ ফেলে গেছি।
মবিন অবাক হওয়ার ভঙ্গি করে বলল, কই? না তো।
মবিনের চেহারায় তখন নিশ্চয়ই কাচুমাচু ভাব কিংবা চোর ভাব ছিল। কারণ রশীদ বলল, দোস্ত টাকা পয়সা কোনো ব্যাপার না। জরুরি কিছু কাগজপত্র ছিল।
অত্যন্ত অপমানসূচক কথা। প্রকারান্তরে বলে দেয়া–টাকাগুলো রেখে মানিব্যাগ ফেরত দাও। এ রকম কঠিন অপমানও মবিন গায়ে মাখলো না। সে ক্ষীণ গলায় বলল, এখানে ফেলিসনি–বাইরে কোথায় ফেলেছিস।
খুব জরুরি কিছু কাগজ ছিল।
তুই নিজেই পরীক্ষা করে দেখ। থাকলে তো মেঝেতেই থাকবে।
এই বলেই মবিন মাথা নিচু করে মেঝেতে মানিব্যাগ খুঁজতে লাগলো। মবিনের বুক এমন ধক ধক করছিল যে মবিনের মনে হলো রশীদ তার বুকের ধক ধক শব্দ পরিষ্কার শুনতে পাচ্ছে।
.
এখনো মবিনের বুকে ধক ধক শব্দ হচ্ছে। এটা তার বুকের শব্দ, না রিকশাওয়ালা যে ইট দিয়ে চেইন বাড়ি দিচ্ছে তার শব্দ, মবিন ঠিক বুঝতে পারছে না। সার্জেন্টটা তাকিয়ে আছে তাদের দিকে। মবিনের, অস্বস্তি লাগছ। একটা সিগারেট ধরাতে পারলে ভালো হতো। সঙ্গে সিগারেট আছে। ধরাতে গেলে হ্যান্ডব্যাগটা খুলে রিকশার সিটে রাখতে হয়। তাতে ব্যাগটার উপর সার্জেন্টের নজর পড়ার সম্ভাবনা। তা করা ঠিক হবে না।
শেষ পর্যন্ত চেইন ঠিক হয়েছে। রিকশা চলতে শুরু করেছে। মবিন সিগারেট ধরালো। ভালো সিগারেট। বেনসন। রশীদের মানিব্যাগ পাওয়ায় রক্ষা। কিছুদিন ভালো সিগারেট খাওয়া গেল। ক্ষতি একটা হয়েছে–রশীদের সঙ্গে সম্পর্ক নষ্ট হয়ে গেছে। সে ঠিক সন্দেহ করেছে। ভুলেও আর মবিনের বাসায় আসে না। সেদিন তার বাসায় কী একটা খাওয়া দাওয়া ছিল। বন্ধু বান্ধব সবাইকে বলেছে, মবিনকে বলেনি। পথে ঘাটে দেখা হলে এমনভাবে তাকায় যেন চিনতে পারছে না।
রশীদের মানিব্যাগ না নিয়ে তার উপায় ছিল না। প্রতিটি পয়সা বাবার কাছে চেয়ে নিতে হয়। চুল কাটতে হবে, ১০ টাকার কমে চুল কাটা যায় না। মবিন যদি তা মা’র কাছে চায় তিনি খুবই অবাক হয়ে বলেন, আমার কাছে টাকা চাচ্ছিস কেনরে? আমি টাকা পয়সার কী জানি? তোর বাবার কাছে থেকে নে। ক্লাস থ্রী ফোরে পড়ার সময় বাবার কাছ থেকে চুল কাটার টাকা চাওয়া যায়। কিন্তু তিন বছর আগে এম, এ পাস করে বসে থাকা একজনের পক্ষে বাবার কাছে চুল কাটার টাকা চাওয়া ভয়াবহ ব্যাপার।
মবিন চুল কাটার জন্যে টাকা চাইলে তিনি টাকা দেন। তবে চাওয়া মাত্র দেন না। অনেক জেরাটেরা করেন।
চুল কাটতে দশ টাকা লাগবে কেন? এয়ার কন্ডিশন্ড সেলুনে বসে চুল কাটবি? দু টাকা দিলেই তো চুল কেটে দেয়।
টাকা দেয়ার পর শুকনো গলায় বলেন, আর কত দিন এভাবে চলবে? ডু সামথিং ইয়াং ম্যান। শো মি সাম ফায়ার।
ফায়ার দেখানোর চেষ্টা মবিন করছে না তা না। তিন বছর ধরে করছে। তার কাঠ ভেজা। তিন বছরেও আগুন জ্বলছে না, শুধু ধোয়া বেরুচ্ছে। সে করবে কি?
.
মবিনের বাবা মোবারক হোসেন ঢাকার একটা মেয়ে কলেজের ইংরেজী ভাষা ও সাহিত্যের অধ্যাপক। সাহিত্যের অধ্যাপক মানেই আবেগ টাবেগ আছে বলে ধারণা। করা হয়। এ ধারণা যে কত ভুল তা মোবারক সাহেবকে না দেখলে বোঝা মুশকিল। বাসায় তিনি কখনো হাসেন না। পরিবারের সবার সঙ্গে যে ব্যবহার করেন তা শুধু ইংরেজী ভাষা ও সাহিত্য কেন যে কোনো বিষয়ের অধ্যাপকের জন্যেই মানান সই নয়। তরকারীতে তেল বেশি হয়ে গেলে স্ত্রীকে ডেকে শান্ত গলায় বলেন, এক মাসের তেল একদিনে খরচ করার জন্যে কেনা হয়নি। তোমার হাতে তেল মশলা বেশি খরচ হয় এই কথা আমি এ পর্যন্ত এক লাখ বার বলেছি। আর বলব না। আবার তেল বেশি হলে ঘর থেকে বিদায় করে দেব। স্ট্রেইট ইন দি স্ট্রিট। অ্যান্ড দিস ইজ ফাইন্যাল।
মোবারক হোসেন সাহেবের রোজগার খারাপ না। কলেজের বেতন ছাড়াও প্রাইভেট টিউশানি করে ভালো টাকা পান। সপ্তাহে তিনদিন বিকেলে তার বাসায় রীতিমতো ক্লাস বসে–রবি, সোম আর মঙ্গল। শুধু বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় একজন ছাত্রী পড়তে আসে। বড়লোকের কোনো মেয়ে হবে। লাল রঙের গাড়িতে করে আসে, গাড়ি করে যায়।
তিনি ইস্ত্রি করা পাঞ্জাবি পরে হাসি মুখে ছাত্রীদের পড়ান। এই সময় তিনি গায়ে খানিকটা সেন্টও মাখেন। পড়াতে গিয়ে মাঝে মাঝেই মজার মজার কিছু কথাও বলেন বলে মনে হয়। কারণ প্রায়ই তার ছাত্রীদের কুটিকুটি হাসি শোনা যায়। যতক্ষণ পড়ান ততক্ষণই তার স্ত্রী পর্দার ওপাশের বারান্দায় ঘোরাঘুরি করেন। স্বামীর হাসির কথায় ছাত্রীরা হাসে, তিনি হন বিস্মিত। তিনি কখনো স্বামীর কোন কথায় হাসতে পারেননি।
মবিন বাসায় ফিরে দেখে গেটের কাছে লাল গাড়ি। বসার ঘরে আলো জ্বলছে। তার মানে আজ বৃহস্পতিবার। বাবার কাছে ছাত্রী এসেছে। বাবার এই ছাত্রীর নাম মীরা। সে অসম্ভব রূপবতী। এই সময় তাদের সামনে দিয়ে ঘরে ঢোকা যাবে না। মোবারক হোসেন সাহেব তাকে দেখলেই অদ্ভুত ভঙ্গিতে তাকাবেন এবং অতি অবশ্যই বলবেন–কোত্থেকে ফিরলি? ডু সামথিং ইয়াংম্যান। শো মি সাম ফায়ার। রূপবতীদের সামনে অপমানিত হতে ভাল লাগে না।
মবিন বাড়ির পেছনে রান্নাঘরের কাছের দরজা দিয়ে চুপিচুপি ঘরে ঢুকলো। বাসায় কোনো চোর ঢুকলে এভাবেই হয়তো ঢুকতো। মবিনের মা রান্নাঘরের বারান্দায় বসেছিলেন। তাকে পাশ কাটিয়ে মবিন নিজের ঘরে চলে গেল। একজন কেউ যে ঘরে ঢুকেছে মবিনের মা বুঝতেও পারলেন না।