করতাছি।
যে সময় নিচ্ছ এই সময়ে তো একটা প্রমাণ সাইজের চেইন বানিয়ে ফেলা যায়।
বানাইতে পারলে বানান।
অন্য সময় হলে ফাজলামি ধরনের কথার কারণে রিকশাওয়ালা কঠিন ধমক খেতো। আজ মবিন ধমক দিতে পারল না। অপরিচিত একজনকে ধমক দিতে হলে রাগের একটা বিশেষ মাত্রা পর্যন্ত উঠতে হয়। রাগ সেই মাত্রায় উঠছে না। চোররা সহজে রাগ করতে পারে না। চোর টাইপের সব লোকই এই কারণে বিনয়ী। অত্যন্ত অপমানসূচক কথা শুনলেও তারা দাঁত কেলিয়ে হাসবে। ভাবটা এ রকম–যেন। অপমানটা সে ধরতে পারছে না।
রিকশার চেইন ঠিক হয়েছে। রিকশা চলতে শুরু করেছে। এখনো কেউ চোর চোর বলে চেঁচাচ্ছে না। আশ্চর্য ব্যাপারতো। মবিন কপালে হাত দিয়ে দেখলো তার কপাল ঘামছে। রিকশা যতই এগুচ্ছে ততই শরীর হালকা লাগছে। ফুরফুরে ভাব চলে আসছে। বৈশাখ মাসের দারুন গরমের পর হঠাৎ যেন দক্ষিণ দিক থেকে খানিকটা হাওয়া চলে এসেছে। এই ব্যাপারটা নিশ্চয়ই হাইজ্যাকারদেরও হয়। তাদের আরো বেশি হওয়ার কথা। হাইজ্যাকিং এর সময় ওদের টেনশান নিশ্চয়ই মবিনের টেনশানের চেয়ে অনেক বেশি থাকে। টেনশান মুক্তির আনন্দও সে কারণেই বেশি হবার কথা।
.
ট্রাফিক সিগন্যালে রিকশা থেমেছে। রাস্তার মোড় বলে আলো বেশি। ট্রাফিক পুলিশের পাশে একজন সার্জেন্টকে বিরস মুখে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা যাচ্ছে। মবিনের বুকের ভেতর কোনো এক জায়গায় সিরসির করে উঠলো। পুলিশ দেখার কারণে বোধ হয়। তার কোলে ভ্যানিটি ব্যাগ চকচক করছে। চাদর গায়ে থাকলে ভালো হত। চাদরের নিচে ব্যাগ লুকিয়ে ফেলা যেত। লাল বাতি নিভে গিয়ে সবুজ বাতি জ্বলছে। রিকশাওয়ালা তবু রিকশা টানছে না। মবিন বলল, দাঁড়িয়ে আছ কেন? চলো।
রিকশাওয়ালা বলল, যাইবেন কই?
মবিন বলল, কোথাও যাব না। খানিকক্ষণ ঘুরব।
রিকশাওয়ালা ঘাড় ঘুরিয়ে তাকালো। যে সব যুবক রিকশায় করে অকারণে ঘুরতে চায় তাদের বিষয়ে সব রিকশাওয়ালাই সাবধান। দিনকাল ভাল না।
সব রিকশা গাড়ি চলছে আর তারটা দাঁড়িয়ে আছে। অস্বস্তিকর অবস্থা। ট্রাফিক পুলিশ তাকিয়ে আছে তাদের দিকে। এইবার সার্জেন্টও তাকাচ্ছে। তাদের দৃষ্টি যেন কেমন কেমন। মবিন রিকশাওয়ালাকে বলল, কী হলো?
রিকশাওয়ালা নির্বিকার গলায় বলল, চেইন ছিলিপ কাটছে।
মনে হচ্ছে চেইন ছিলিপ কাটায় সে আনন্দিত। পুলিশ সার্জেন্ট এগিয়ে আসছে তাদের দিকে। সে কি মবিনের দিকে তাকিয়ে সন্দেহজনক ভঙ্গিতে বলবে–আপনার হাতে মেয়েদের ব্যাগ কেন?
বলার কোনো কারণ নেই। পুরুষের হাতে মেয়েদের ব্যাগ থাকা নিষিদ্ধ কিছু না, থাকতে পারে। সে যদি মেয়েদের মতো ব্যাগ কাঁধে ঝুলিয়ে বসে থাকতো তাহলে চোখে পড়ার মতো ব্যাপার হতো। পুরুষ মানুষ ভাজ করা শাড়ি হাতে নিয়ে যেতে পারে কিন্তু শাড়ি পরে যেতে পারে না।
সার্জেন্ট এসেই রিকশাওয়ালার গালে ওজনদার এক চড় বসিয়ে দিয়ে বলল, হারামী চেইন ফেলনের জায়গা পাও না। রিকশা নিয়া দূরে যাও।
সার্জেন্ট অতঃপর যে কান্ডটি করলো তার জন্যে মবিন ঠিক প্রস্তুত ছিল না। সার্জেন্ট রিকশার পেছনে গিয়ে আচমকা একটা ধাক্কা দিলো। মবিন প্রায় হুমড়ি খেয়ে পড়তে গিয়ে নিজেকে সামলে নিলো। দু’টা কাজই ঘোরতর অন্যায়ের পর্যায়ে পড়ে। পুলিশ ব্রুটালিটি। মবিনের উচিত সার্জেন্টের সঙ্গে কিছু উত্তপ্ত কথাবার্তা বলা। পুলিশের সঙ্গে কথা কাটাকাটি করলে মানবিক দিক দিয়ে তৃপ্তি পাওয়া যায়। মনে হয় একটা সকাজ করা হয়েছে। মবিন সে রকম কিছুই করলো না। বরং সার্জেন্টের দিকে তাকিয়ে এমন ভঙ্গিতে হাসলো যার অর্থ, স্যার খুব ভালো করেছেন। ঢাকা শহরটা রিকশাওয়ালারা নষ্ট করে ফেলছে। ব্যাটাকে আরো চড় দেন। এক চড়ে ওর শিক্ষা হবে না। গোটা পাঁচেক চড় দরকার।
মবিনের রিকশা রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে। রিকশাওয়ালা গেছে ইটের সন্ধানে। ইট দিয়ে বাড়ি না দিলে নাকি চেইন ঠিক হবে না। মবিন অস্বস্তি নিয়ে বসে আছে, কারণ সার্জেন্ট কাছেই দাঁড়িয়ে। কয়েকবার দেখলো মবিনকে। সরু চোখে দেখা। তার মনে কি কোনো রকম সন্দেহ দেখা দিয়েছে? মবিনের চেহারায় কি চোর চোর ছাপ স্পষ্ট হয়ে উঠেছে? যে ছাপ শুধু পুলিশের পক্ষেই বোঝা সম্ভব। সাপের হাঁচি বেদেয় চেনে। ঈদের বাজারে প্রচুর ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটছে। তার হাতে মেয়েদের ব্যাগ দেখে পুলিশের সন্দেহ হওয়া স্বাভাবিক যে সে ব্যাগ ছিনতাই করে রিকশা নিয়ে পালাচ্ছে। সার্জেন্ট যদি কাছে এসে জিজ্ঞেস করে, আপনার হাতের ব্যাগটা কার? তাহলে সে কি বলবে? এমনো তো হতে পারে যে, ব্যাগে প্রচুর টাকা পয়সা গয়না-টয়না ছিল। যার ব্যাগ সে ব্যাগের বর্ণনা দিয়ে থানায় ডাইরী করিয়েছে। ওয়াকিটকির মাধ্যমে সে খবর সব পুলিশ সার্জেন্টের কাছ চলে গিয়েছে। বাংলাদেশের পুলিশ বড় চোর ধরতে পারে না। ছোট চোর চট করে ধরে ফেলে। তাছাড়া মবিন আয়নায় নিজেকে না দেখেই পরিষ্কার বুঝতে পারছে, তার চেহারায় একটা কাচুমাচু ভাব চলে এসেছে।
মাসখানেক আগে এ রকম একটা ব্যাপার হলো। দুপুর বেলা তার ঘরে কয়েক বন্ধু মিলে অনেকক্ষণ আড্ডা দিল। বন্ধুদের মধ্যে ছিল রশীদ। বিরাট মালদার। বাপের কন্ট্রাকটারিতে নেমে ভাল পয়সা কামাচ্ছে। আটমাসের গর্ভবতী মেয়েদের মতো পেট মোটা মানিব্যাগ পকেটে নিয়ে সে ঘোরে। কৃপণের হাড্ডি। একটা পয়সা বের করে না। বন্ধুরা চলে যাওয়ার পর বিস্ময় ও আনন্দ নিয়ে মবিন দেখলো রশীদের গর্ভবতী মানিব্যাগ মেঝেতে পড়ে আছে। সে ইচ্ছা করলেই রাস্তা থেকে ডাক দিয়ে রশীদকে। নিয়ে আসতে পারতো। তা করলো না। মানিব্যাগ খুলে ভেতরটা দেখলো। কাগজপত্রে ঠাসা, আসল জিনিস তেমন নেই। চারটা ৫০০ টাকার নোট, একটা ১০০ টাকার। নোট। তিনটা অতি ময়লা দু টাকার নোট। মবিন মানিব্যাগটা তোষকের নিচে ঠেলে দিল। তার প্রায় ঘন্টা খানিক পর রশীদ এসে উপস্থিত। মুখ চোখ শুকনা।