বৌ চলে গেছে গত বৈশাখ মাসে। কোথায় গেছে কেউ জানে না। পাড়ার কয়েকজনকে জিজ্ঞেস করেছিল। কেউ বলতে পারে না। একজন বলল, অনেক দিন তো থাকল, আর কত? বাজারে গিয়া খোঁজ নেও। মনে হয় বাজারে ঘর নিছে। জগতের অনেক সত্যের মত এই সত্যও সে গ্রহণ করেছে সহজভাবে। চোর-ডাকাতের বৌদের শেষ আশ্রয় হয় বাজার। বাজারে তারা মোটামুটি সুখেই থাকে। মুখে রঙ-চঙ মেখে সন্ধ্যাকালে চিকন গলায় ডাকে, ও বেপারি, আহেন, পান-তামুক খাইয়া যান। শীতের দিন শইলডা গরম করন দরকার আছে।
অবসর পেলেই মতি আজকাল বাজারে-বাজারে ঘুরে। বৌটাকে পাওয়া গেলে মনে শান্তি। তাকে নিয়ে ঘর-সংসার আর করবে না। তাতে লাভ কি? বৌটা কোন এক জায়গায় থিতু হয়েছে এটা জানা থাকলেও মনে আনন্দ। মাঝে-মধ্যে আসা যাবে। আপনার মানুষের কাছে কিছুক্ষণ বসলেও ভাল লাগে। আপনার মানুষ সংসারে থাকলেও আপনার, বাজারে থাকলেও আপনার।
বৌ কেন্দুয়া বাজারে আছে এরকম একটা উড়া খবর শুনে মতি কেন্দুয়া এসেছিল। উড়া-খবর কখনো ঠিক হয় না। তার বেলা ঠিক হয়ে গেল। বৌ এখানেই আছে। নাম নিয়েছে মর্জিনা। বাজারে ঘর নিলে নতুন নাম নিতে হয়। মর্জিনার সঙ্গে দেখা করতে যাবার মুখে এই বিপদ।
.
আজান হচ্ছে। আছরের ওয়াক্ত হয়ে গেছে। মতি অনেক কষ্টে পাশ ফিরল। তারা চোখ কখন তুলবে? নামাজের আগে নিশ্চয়ই না। কিছুটা সময় এখনো হাতে আছে। এর মধ্যে কত কিছু হয়ে যেতে পারে। মহাখালি রেল স্টেশনে সে একবার ধরা পড়ল। তাকে মেরেই ফেলত। ট্রেনের কামরা থেকে একটা মেয়ে ছুটে নেমে এল। চিৎকার করে বলল, আপনারা কি মানুষটাকে মেরে ফেলবেন? খবর্দার, আর না। খবর্দার। মেয়েটির মূর্তি দেখেই লোকজন হকচকিয়ে গেল। লোকজনের কথা বাদ থাক, সে নিজেই হতভম্ব। জীবন বাঁচানোর জন্যে মেয়েটিকে সামান্য ধন্যবাদও দেয়া হয়নি। ট্রেন ছেড়ে দিয়েছে। সেই মেয়ে চলে গেছে কোথায় না কোথায়।
আজ এই যে এত লোক চারপাশে ভিড় করে আছে এদের মধ্যেও নিশ্চয়ই কেউ -কেউ আছে ঐ মেয়েটির মত। সে অবশ্যই শেষ মুহূর্তে ছুটে এসে বলবে, করেন কি! করেন কি! আর এতেই মতির নয়ন রক্ষা পাবে। এইটুক বিশ্বাস তো মানুষের প্রতি রাখতেই হবে। মতি মিয়া অপেক্ষা করে। কে হবে সেই লোকটি? না জানি সে দেখতে। কেমন। সেই লোকটির চোখ কি ট্রেনের মেয়েটির চোখের মত মমতামাখা হবে? যে চোখের দিকে তাকালে ভাল হয়ে যেতে ইচ্ছা করে? মতি মিয়া চাপা উত্তেজনা নিয়ে অপেক্ষা করে, অপেক্ষা করতে তার ভালই লাগে।
চোর
রিকশায় ওঠার সময় পায়ে কী যেন বাধলো। মবিন প্রায় উল্টে পড়ে যাচ্ছিল। নিজেকে সামলে নিয়ে দেখে পায়ের কাছে মেয়েদের একটা বাহারি হ্যান্ডব্যাগ। অষ্টম আশ্চর্যের কাছাকাছি ঘটনা। ঢাকা শহরে রাস্তায় এমন সুন্দর একটা হ্যান্ডব্যাগ পড়ে থাকবে আর কেউ কুড়িয়ে নেবে না তা হয় না। হাত থেকেই টেনে ব্যাগ নিয়ে যায়। আর এটাতো পড়ে আছে রাস্তায়। মবিন নিচু হয়ে ব্যাগ হাতে নিলো। বেশ ভারি ব্যাগ। ঈদের বাজার শুরু হয়েছে। মেয়েরা এখন ব্যাগ ভর্তি টাকা নিয়ে বের হয়। হাইজ্যাকারের ভয়ে গায়ের গয়না টয়নাও খুলে ব্যাগে রাখে। ভারি হওয়াই স্বাভাবিক। মবিন বেশ স্বাভাবিক ভঙ্গিতে রিকশায় উঠে বসলো। নিজেকে খানিকটা চোর চোর লাগছে। মনে হচ্ছে, এই বুঝি তীক্ষ্ণ মেয়েলী গলায় কেউ একজন চেঁচিয়ে বলবে–আপনি আমার। ব্যাগ নিয়ে কোথায় যাচ্ছেন?
কেউ কিছু বলল না। যার জিনিস সেকি দূর থেকে ব্যাপারটা লক্ষ্য করছে? অবাক হয়ে দেখছে নিতান্ত ভদ্র চেহারার একটা ছেলে ব্যাগ নিয়ে রিকশা করে পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টায় আছে। সে বিস্ময়ে হতভম্ব বলে কিছু বলতে পারছে না। হতভম্ব ভাবটা কাটলেই চোর চোর বলে চেঁচিয়ে উঠবে। মেয়েদের ভীত গলার চিৎকার সাইরেনের চেয়েও ভয়াবহ। নিমিষের মধ্যেই লোকে লোকারণ্য হয়ে যাবে।
সময়টা ভর সন্ধ্যা। সন্ধ্যা হচ্ছে অস্থির ধরনের সময়। এই সময় লোকজন এক ধরনের অস্থিরতার ভিতর থাকে। চারপাশে তেমন করে দেখে না। মবিন মোটামুটি নিশ্চিত হলো, যার ব্যাগ সে আশপাশে নেই। থাকলে এতক্ষণে চেঁচিয়ে উঠতো। চুপচাপ অপেক্ষা করার মতো ধৈর্য কোনো মেয়ের নেই। মবিনের ধারণা, শুধু শিশু পালনের ক্ষেত্রেই মেয়েরা ধৈর্যশীলা–অন্য কোনো ক্ষেত্রে নয়।
রিকশাওয়ালা বলল, যাইবেন কই?
মবিন ঠিক মনে করতে পারল না কোথায় যাওয়ার জন্যে সে রিকশায় উঠেছে। মনে হচ্ছে টেনশানে তার ব্রেইন শর্টসার্কিট হয়ে গেছে। সে বলল, সামনে চলো—সামনে। রিকশা সামনে এগুচ্ছে না। চেইন পড়ে গেছে। রিকশাওয়ালা চেইন নিয়ে ঘটঘট করছে। তাড়াতাড়ি এখান থেকে সরে পড়া উচিত। সরে পড়া যাচ্ছে না। একটা
সামান্য চেইন ঠিক করতে রিকশাওয়ালা দেখি বুড়ো হয়ে যাচ্ছে। মবিন আশপাশে। তাকালো। তার মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে কেউ তাকে অস্বাভাবিক চোখে দেখছে কিনা তা লক্ষ্য করা। সবার চোখই তার কাছে অস্বাভাবিক লাগছে। মবিনের তীব্র ইচ্ছা করছে। রিকশা থেকে নেমে লম্বা লম্বা পা ফেলে। যাকে বলে ক্রাইম স্পট থেকে পগার পাড়।
মবিন রাগি গলায় বলল, রিকশায় কী হয়েছে?
চেইন ছিলিপ কাটছে।
ছিলিপ কাটলে ছিলিপ ঠিক কর।