অসুখটা এমন যে কাউকে বলা যাচ্ছে না। বললে কেউ বিশ্বাস করবে, কিংবা বিশ্বাস করার ভান করে আড়ালে হাসাহাসি করবে। একজনকে অবিশ্যি বলা যায়। জাভেদকে। জাভেদ তার স্বামী। স্বামীর কাছে কিছু গোপন থাকা উচিত নয়। অসুখবিসুখের খবর সবার আগে স্বামীকেই বলা দরকার।
কিন্তু মুশকিল হচ্ছে জাভেদের সঙ্গে প্রিয়াংকার পরিচয় এখনও তেমন গাঢ় হয়নি। হবার কথাও নয়। তাদের বিয়ে হয়েছে একুশ দিন আগে। এখনও প্রিয়াংকার তুমি বলা রপ্ত হয়নি। মুখ ফসকে আপনি বলে ফেলে। এরকম গম্ভীর, বয়স্ক একজন মানুষকে তুমি বলাও অবিশ্যি খুব সহজ নয়। মুখে কেমন বাধোবাধো ঠেকে। প্রিয়াংকা চেষ্টা করে আপনি তুমি কোনটাই না বলে চালাতে। যেমন— তুমি চা খাবে? না বলে সে বলে চা দেব? এইভাবে দীর্ঘ আলাপ চালানো যায় না, তার চেয়েও বড় কথা মানুষটা খুব বুদ্ধিমান। ভাববাচ্যে কিছুক্ষণ কথা বলার পরই সে হাসিমুখে বলে, তুমি বলতে কষ্ট হচ্ছে, তাই না?
তুমি বলতে কষ্ট হওয়াটা দোষের কিছু না। প্রিয়াংকার বয়স মাত্র সতেরো। তাও পুরোপুরি সতেরো হয়নি। জুন মাসে হবে। এখনও দুমাস বাকি। আর ঐ মানুষটার বয়স খুব কম ধরলেও ত্রিশ। তার বয়সের প্রায় দ্বিগুণ। সারাক্ষণ গম্ভীর থাকে বলে বয়স আরো বেশি দেখায়। বরের বয়স বেশি বলে প্রিয়াংকার মনে কোনো ক্ষোভ নেই। বরদের চ্যাংড়া চ্যাংড়া দেখালে ভালো লাগে না। তাছাড়া মানুষটা অত্যন্ত ভালো। ভালো এবং বুদ্ধিমান। কমবয়েসী বোকা বরের চেয়ে বুদ্ধিমান বয়স্ক বর ভালো।
বিয়ের রাতে নানান কিছু ভেবে প্রিয়াংকা আতঙ্কে অস্থির হয়েছিল। ধক ধক করে বুক কাঁপছিল। কপাল রীতিমতো ঘামছিল। মানুষটা সঙ্গে সঙ্গে তা বুঝে ফেলেছিল। কাছে এসে ভারী গলায় বলল, ভয় করছে? ভয়ের কী আছে বলো তো?
প্রিয়াংকার বুকের ধকধকানি আরো বেড়ে গেল। সে হাঁ না কিছুই বলল। একবার মনে হলো সে অজ্ঞান হয়ে যাচ্ছে। মানুষটা তখন নরম গলায় বলল, ভয়ের কিছু নেই। ঘুমিয়ে পড়ো। বলেই প্রিয়াংকার গায়ে চাদর টেনে দিল। তার গলার স্বরে কিছু একটা ছিল। প্রিয়াংকার ভয় পুরোপুরি কেটে গেল এবং প্রায় সঙ্গে সঙ্গে ঘুমিয়ে পড়ল। অনেক রাতে একবার ঘুম ভেঙে দেখে লোকটি অন্যপাশ ফিরে ঘুমুচ্ছে। খানিকক্ষণ জেগে থেকে প্রিয়াংকা আবার ঘুমিয়ে পড়ল। ঘুম ভাঙল অনেক বেলায়, লোকটি তখন পাশে নেই।
একটা মানুষকে চেনার জন্যে একুশ দিন খুব দীর্ঘ সময় নয়। তবু প্রিয়াংকার ধারণা মানুষটা ভালো। বেশ ভালো। এরকম একজন মানুষকে তার অসুখের কথাটা অবশ্যই বলা যায়। কিন্তু মুশকিল হচ্ছে অসুখটার সঙ্গে এই মানুষটার সম্পর্ক আছে। এই কারণেই তাকে বলা যাবে না। কিন্তু কাউকে বলা দরকার। খুব তাড়াতাড়ি বলা দরকার। নয়তো সে পাগল হয়ে যাবে। কিছুটা পাগল সে বোধহয় হয়েই গেছে। সারাক্ষণ অস্থির লাগে। সন্ধ্যা মেলাবার পর শরীর কাঁপতে থাকে। তৃষ্ণায় বুক শুকিয়ে কাঠ হয়ে থাকে। গ্লাসের পর গ্লাস পানি খেলেও তৃষ্ণা মেটে না। সামান্য শব্দে ভয়ংকর চমকে ওঠে। সেদিন বাতাসে জানালার কবাট নড়ে উঠল, সঙ্গে সঙ্গে ভয়ে অস্থির হয়ে গোঙানির মতো শব্দ করল প্রিয়াংকা। হাতের চায়ের কাপ থেকে সবটা চা ছলকে পড়ল শাড়িতে। ভাগ্যিস আশপাশে কেউ ছিল না। কেউ থাকলে নিশ্চয়ই খুব অবাক হতো। প্রিয়াংকার ছোট মামা যেমন অবাক হলেন।
তিনি প্রিয়াংকাকে দেখতে এসেছিলেন। তার দিকে তাকিয়েই বিস্মিত গলায় বললেন, তোর কী হয়েছে রে? প্রিয়াংকা হালকা গলায় বলল, কিছু হয়নি তো! তুমি কেমন আছ মামা?
আমার কথা বাদ দে, তোকে এমন লাগছে কেন?
কেমন লাগছে?
চোখের নিচে কালি পড়েছে। মুখ শুকনো। কী ব্যাপার?
কোনো ব্যাপার না মামা।
গালটাল ভেঙে কী অবস্থা। তুই কথাও তো কেমন অন্যরকমভাবে বলছিস।
কীরকমভাবে বলছি? মনে হচ্ছে তোর গলাটা ভাঙা। ঠাণ্ডা লেগেছে মামা।
প্রিয়াংকা কয়েকবার কাশল। মামাকে বোঝাতে চাইল যে তার সত্যি সত্যি কাশি হয়েছে, অন্যকিছু না। মামা আরো গম্ভীর হয়ে গেলেন। শীতল গলায় বললেন, আর কিছু না তো?
না।
ঠিক করে বল।
ঠিক করেই বলছি।
প্রিয়াংকার কথায় তার মামা খুব আশ্বস্ত হলেন বলে মনে হলো না। সারাক্ষণ গম্ভীর হয়ে রইলেন। চায়ের কাপে দুটা চুমুক দিয়েই রেখে দিলেন। যাইরে মা বলেই কোনোদিকে না তাকিয়ে হনহন করে চলে গেলেন। মামা চলে যাবার এক ঘণ্টার ভেতরই মামি এসে হাজির। বোঝাই যাচ্ছে মামা পাঠিয়ে দিয়েছেন।
মামি প্রিয়াংকাকে দেখে আঁতকে উঠলেন। প্রায় চেঁচিয়ে বললেন, এক সপ্তাহ আগে তোকে কী দেখেছি আর এখন কী দেখছি? কী ব্যাপার তুই খোলাখুলি বল তো। কী সমস্যা?
প্রিয়াংকা শুকনো হাসি হেসে বলল, কোনো সমস্যা না।
মামি কঠিন গলায় বললেন, তুই বলতে না চাইলে আমি কিন্তু জামাইকে জিজ্ঞেস করব। জামাই আসবে কখন?
ও আসবে রাত আটটার দিকে। ওকে কিছু জিজ্ঞেস করতে হবে না মামি। আমিই বলছি।
বল, কিছু লুকোবি না।
প্রিয়াংকা প্রায় ফিসফিস করে বলল, আমি ভয় পাই মামি।
কিসের ভয়?
কী যেন দেখি। নিজেও ঠিক জানি না কী দেখি।
ভাসাভাসা কথা বলবি না। পরিষ্কার করে বল কী দেখিস।
প্রিয়াংকা এক পর্যায়ে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠে বলল, মামি আমি বোধহয় পাগল হয়ে গেছি। আমি কীসব যেন দেখি।
সে কী দেখে তা তিনি অনেক প্রশ্ন করেও বের করতে পারলেন না। প্রিয়াংকা অন্যসব প্রশ্নের জবাব দেয় কিন্তু কী দেখে তা বলে না। এড়িয়ে যায় বা কাঁদতে শুরু করে।