- বইয়ের নামঃ ছায়াসঙ্গী
- লেখকের নামঃ হুমায়ূন আহমেদ
- প্রকাশনাঃ দিব্যপ্রকাশ
- বিভাগসমূহঃ ছোট গল্প, গল্পের বই, ভূতের গল্প
ওইজা বোর্ড
প্রায় আট বছর পর নাসরিনের বড় ভাই আলাউদ্দিন দেশে ফিরল। সঙ্গে বিদেশি বউ। বউয়ের নাম ক্লারা। বউয়ের চুল সোনালি, চোখ ঘন নীল, মুখটাও মায়া-মায়া। তবু মেয়েটাকে কারোই পছন্দ হলো না।
যে-পরিমাণ আগ্রহ নিয়ে নাসরিন বড় ভাইয়ের জন্যে অপেক্ষা করছিল, ভাইকে দেখে সে ঠিক ততখানি নিরাশ হলো। আট বছর আগে নাসরিনের বয়স ছিল নয়, এখন সতেরো। নবছর বয়েসী চোখ এবং সতেরো বছর বয়েসী চোখ একরকম নয়। নবছর বয়েসী চোখ সবকিছুই কৌতূহল এবং মমতা দিয়ে দেখে। সতেরো বছরের চোখ বিচার করতে চেষ্টা করে। তার বিচারে ভাই এবং ভাইয়ের বউ দুজনকেই খারাপ লাগছে।
নাসরিন দেখল তার ভাই আগের মতো চুপচাপ শান্ত ধরনের ছেলে নয়— খুব হইচই করা শিখেছে। স্ত্রীকে নিয়ে সবার সামনে বেশ আহ্লাদ করছে। ঠোট গোল করে হানি ডাকছে। অথচ হানি শব্দটা বলার সময় ঠোট গোল হয় না।
আলাউদ্দিন এতদিন পর দেশে আসছে, আত্মীয়-স্বজনদের জন্যে উপহার-টুপহার আনা উচিত ছিল, তেমন কিছুই আনেনি। ভুসভুসা অ্যাশ কালারের একটা সোয়েটার এনেছে মার জন্যে। সেই সোয়েটার নিয়ে কতরকম আদিখ্যেতা–পিওর উল মা। পিওর উল আজকাল আমেরিকাতেও এক্সপেনসিভ। মা তোমার কি কালার পছন্দ হয়েছে?
নাসরিনের একবার বলার ইচ্ছা হলো— অ্যাশ কালারের পছন্দের কী আছে ভাইয়া?
সে অবিশ্যি কিছু বলল না। তার মনটাই খারাপ হয়ে গেল। এতদিন পর আসছে। ভাইয়ার কি উচিত ছিল না মার জন্যে একটা ভালো কিছু আনা?
বাবার জন্যে এনেছে ক্যালকুলেটর। যে-বাবা রিটায়ার করেছে, চোখে দেখতে পায় না, সে ক্যালকুলেটর দিয়ে কী করবে?
নাসরিনের বড় বোন শারমিন তার দুই যমজ মেয়েকে নিয়ে সুটকেস খোলার সময় বসে ছিল। এই দু-মেয়েকে আলাউদ্দিন দেখেনি। চিঠি লিখে জানিয়েছে এই দু-মেয়ের জন্যে একই রকম দুটো জিনিস নিয়ে আসবে যা দেখে দুজনই মুগ্ধ হবে। দুজনের জন্যে দুটো গায়েমাখা সাবান বেরুল। এই সাবান ঢাকার নিউ মার্কেট ভরতি, আমেরিকা থেকে বয়ে আনতে হয় না।
আলাউদ্দিন বলল, বেশি কিছু আনতে পারিনি বুঝলি। লাস্ট মোমেন্টে ক্লারা ডিসাইড করল আমার সঙ্গে আসবে। অনেকগুলি টাকা বেরিয়ে গেল। কিছু টাকা সঙ্গেও রাখতে হয়েছে। ঢাকায় হোটেলের বিল কেমন কে জানে!
নাসরিন বলল, হোটেলের বিল মানে? তুমি কি হোটেলে উঠবে?
বাধ্য হয়ে উঠতে হবে। এই গাদাগাদি ভিড়ে ক্লারার দম বন্ধ হয়ে আসছে। চট করে তো সব অভ্যাস হয় না। আস্তে আস্তে হয়। তোরা আবার এটাকে কোন ইস্যু বানিয়ে বসবি না। তোদের কাজই তো হচ্ছে। সামান্য ব্যাপারটাকে কোনোমতে ফুলিয়ে-ফাঁপিয়ে ইস্যুতে নিয়ে যাওয়া।
নাসরিনের চোখে পানি এসে গেল। তার আপন বড় ভাই তার সঙ্গে এমন ব্যবহার করবে সে স্বপ্নেও ভাবেনি। নাসরিনের চোখের পানি অবিশ্যি কেউ দেখতে পেল না। একটু আসছি ভাইয়া বলেই সে চট করে উঠে গেল। বাথরুমে কিছুক্ষণ কাটিয়ে চোখ মুছে উপস্থিত হলো। আলাউদ্দিন তখন সুটকেস খুলে আরো কীসব উপহার বের করছে। অতি তুচ্ছ সব জিনিস— গাড়ির পেছনে লাগানোের স্টিকার, যেখানে লেখা Hug Your Kids। তাদের গাড়ি কোথায় যে তারা গাড়ির পেছনে স্টিকার লাগাবে? কেউ অবিশ্যি কিছু বলল না। সবাই এমন ভাব করতে লাগল যে গাড়ির স্টিকারটার খুব প্রয়েজন ছিল।
আলাউদ্দিন বলল, নাসরিন তোর জন্যে তো কিছু আনা হয়নি।
নাসরিন বলল, ভাইয়া আমার কিছু লাগবে না।
তোকে বরং এখান থেকেই শাড়ি-টাড়ি কিছু কিনে দেব।
আচ্ছা।
আলাউদ্দিন সুটকেস ঘাঁটতে লাগল। তার ঘাঁটার ভঙ্গি দেখে মনে হয় সে আশা করছে কিছু একটা পেয়ে যাবে যা নাসরিনকে দিতে পারলে শাড়ির ঝামেলায় যেতে হবে না। নাসরিনের লজ্জার সীমা রইল না।
এই যে জিনিস পাওয়া গেছে।
হাসিতে আলাউদ্দিনের মুখ ভরে গেল। সবাই ঝুঁকে পড়ল সুটকেসের ওপর। লিপস্টিকের মতো একটা বস্তু বেরুক্ল। আলাউদ্দিন বলল–নাসরিন নে। এর নাম লিপ গ্লস। ঠোটে দিলে ঠোট চকচক করে, ঠোঁট ফাটে না।
নাসরিন শুকনো গলায় বলল, থ্যাংকস ভাইয়া।
আলাউদ্দিন বিরক্ত গলায় বলল— গিফট হচ্ছে গিফট। গিফটের মধ্যে সস্তা দামি কোনো ব্যাপার না। বাঙালিদের স্বভাব হচ্ছে কোনো উপহার পেলেই হিসাব-নিকাশে বসে যাবে। দাম কত, কী!
নাসরিন বলল, আমি কোনো হিসাব-নিকাশ করছি না ভাইয়া। লিপ গ্লসটা আমার খুব পছন্দ হয়েছে।
দ্যাটস গুড। মাই গড–-নাসরিন তোর ভাগ্য ভালো আরেকটা জিনিস পাওয়া গেছে–ওইজা বোর্ড। এতক্ষণ চোখেই পড়েনি।
ওইজা বোর্ড আবার কী?
আলাউদ্দিন লুডু বোর্ডের মতো একটা বোর্ড মেলে ধরল। চারদিকে এ থেকে জেড পর্যন্ত লেখা— মাঝখানে দুটা ঘর— একটায় লেখা ইয়েস একটায় নো।
এটা কি কোনো খেলা ভাইয়া?
খেলাই বলতে পারিস। ভূত নামানোর খেলা। প্ল্যানচেটের নাম শুনিসনি? এটা দিয়ে প্ল্যানচেটের মতো করা যায়।
কীভাবে?
লাল বোতামটা দেখছিস না? দুজন বা তিনজন মিলে খুব হালকাভাবে তর্জনী দিয়ে এটাকে টাচ করে রাখবি, কোনোরকম প্রেশার দেয়া যাবে না। বোতামটাকে রাখবি বোর্ডের ঠিক মাঝখানে। ঘরের আলো কমিয়ে দিবি আর মনে-মনে বলবি If any good soul passes by, please come. তখন আত্মাটা বোতামে চলে আসবে। বোম নড়তে থাকবে। তখন কোনো প্রশ্ন করলে আত্মা জবাব দেবে।