চা লাগবে না।
কেন লাগবে না? চা খেতে খেতে গল্প করব। আমার ঘটনাটা আপনাকে বলব। আপনাকে বলার জন্যে আমি একধরনের আগ্রহ অনুভব করছি।
কেন বলুন তো?
আপনি বিজ্ঞানের মানুষ। আপনি শুনলে একটা ব্যাখ্যা হয়তো দাঁড় করাতে পারবেন। অবিশ্যি ব্যাখ্যার জন্যে আমি খুব ব্যস্তও না। প্রতিটি বিষয়ের পেছনে একটা কার্যকারণ যে থাকতেই হবে এমন তো কোনো কথা নেই। আমরা কোত্থেকে এসেছি, আমরা কোথায় যাচ্ছি— এই বিষয়গুলোর তো এখনও মীমাংসা হয়নি, কী বলেন প্রফেসর সাহেব…
অন্য সময় হলে এই ভদ্রলোকের কথায় আমি তেমন কোনো গুরুত্ব দিতাম না। কিন্তু যার বাড়িতে বইয়ের সংখ্যা ষোলো হাজার তাঁর কথা মন দিয়ে শুনতে হয়। তাঁর তুচ্ছতম কথাও আগ্রাহ্য করা যায় না।
ভদ্রলোকের গল্প সেই কারণেই অতি আগ্রহ নিয়ে শুনলাম। যেভাবে শুনেছি ঠিক সেইভাবে বলার চেষ্টা করছি। ভদ্রলোক গল্পের মাঝামাঝি পর্যায়ে এসে ইংরেজিতে বলা শুরু করেছেন। আমি তা করছি না। কোনোরকম ব্যাখ্যা বা টীকা-টিপ্পনীও দিচ্ছি না। পুরোটা পাঠকদের ওপর ছেড়ে দিচ্ছি।
ভাই ঘটনাটা তা হলে বলা শুরু করি।
কিছু-কিছু মানুষ আছে পশুপ্রেমিক। কুকুর-বেড়াল, গরু-ভেড়া এইসব জস্তুর প্রতি তাদের অসাধারণ মমতা। রাস্তায় একজন ভিখিরি চিৎকার করে কাঁদলে সে ভিখিরির কাছে এগিয়ে যাবে না, কিন্তু একটা বিড়াল কুঁইকুই করে কাঁদলে ছুটে যাবে, বিড়ালটাকে পানি খাওয়াবে।
আপনাকে শুরুতেই বলে রাখি, আমি এরকম কোনো পশুপ্রেমিক না। কুকুর বেড়াল এইসব আমার অপছন্দের প্রাণী। একটা গরু বা ভেড়ার গায়ে আমি হাত দিতে পারি কিন্তু কুকুর বা বেড়ালের গায়ে হাত দিতে আমার ঘেন্না লাগে। তা ছাড়া ডিপথেরিয়া, জলাতঙ্ক এইসব অসুখ এদের মাধ্যমে ছড়ায় এটাও আমি সবসময় মনে রাখি।
যা-ই হোক, মূল গল্পে ফিরে যাই। আমি তখন ইন্টারমিডিয়েট ফার্স্ট ইয়ারে পড়ি। শীতকাল। কলেজে প্র্যাকটিক্যাল শেষ করে বাসায় ফিরতে ফিরতে সন্ধ্যা হয়ে যায়। তখন পড়ি কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজে। আমাদের বাসা ঠাকুরপাড়ায়।
একদিন বাসায় ফিরছি। দিনটা মনে আছে, বুধবার। সন্ধ্যা মিলিয়ে গেছে। গায়ে গরম কাপড় ছিল না। প্রচণ্ড শীত লাগছে। বাসার কাছাকাছি এসে দেখি পাড়ার তিন-চারটা ছেলে কাগজ, শুকনো কাঠ এইসব জড়ো করে আগুন করছে। আমাদের সামনের বাসার নান্টুকেও দেখা গেল। মহা তঁাদড় ছেলে। তার হাতে একটা কুকুরছানা। ছানাটার গায়ে কাপড় জড়ানো—শুধু মুখ বের হয়ে আছে। কুকুরছানা আরামে কুঁইকুঁই করছে।
আমি বললাম, কী হচ্ছে রে নান্টু?
নান্টু দাঁত বের করে হাসল। অন্য একজন বলল, নান্টু কুকুরকে কম্বল পরিয়েছে। শীত লাগে তো এইজন্যে। দলের বাকি সবাই হোহো করে হেসে উঠল। ছেলেগুলির বয়স দশ থেকে এগারোর মধ্যে। এই বয়সের বালকরা সবসময় খুব আনন্দে থাকে। নানা জায়গা থেকে আনন্দের উপকরণ সংগ্রহ করে। কুকুরকে কাপড় দিয়ে মোড়া হয়েছে এতেই তাদের আনন্দের সীমা নেই।
মানুষের সাধারণ প্রবৃত্তি হচ্ছে আনন্দে অংশগ্রহণ করা। আমি ওদের দিকে এগিয়ে গেলাম। অবাক হয়ে লক্ষ করলাম আমার এগিয়ে যাওয়াটা কেউ তেমন পছন্দ করছে না। মুখ-চাওয়াচাওয়ি করছে। হয়তো তারা চায় না ছোটদের খেলায় বড়রা অংশগ্রহণ করুক। নান্টুকে খুবই বিরক্ত মনে হলো।
ওদের কাছে গিয়ে দাঁড়ানোমাত্র কেরোসিনের গন্ধ পেলাম। হয়তো বাসা থেকে কেরোসিন এনে কেরোসিন ঢেলে আগুন করেছে। বালকরা কায়দাকানুন করতে খুব ভালোবাসে।
কেরোসিন দিয়েছিস নাকি?
কেউ কোনো জবাব দিল না। নান্টুর মুখ কঠিন হয়ে গেল। আমি ব্যাপারটা কিছুই বুঝতে পারছি না। নান্টু বলল, আপনি চলে যান। তার গলা কঠিন। চোখের দৃষ্টি তীক্ষ্ণ। তাকিয়ে দেখি নান্টুর কোলের কুকুরছানা ভিজে চুপচুপ করছে। বুকটা ধক করে উঠল। এরা ছানাটার গায়ের কাপড় কেরোসিন দিয়ে চুবিয়েছে নাকি? নতুন কোনো খেলা? একে আগুনে ছেড়ে দেবে না তো? শিশুরা মাঝে মাঝে নিষ্ঠুর খেলায় মেতে ওঠে। আমি কড়া গলায় বললাম, এই নান্টু, তুই কুকুরটার গায়ে কেরোসিন ঢেলেছিস?
নান্টু কঠিন মুখে বলল, তাতে আপনার কী?
কেন কেরোসিন ঢালবি?
নান্টু কিছু বলল না। অন্য একজন বলল, কুকুরটা আগুনের মধ্যে ছাড়বে। এর গলায় ঘুঙুর বাঁধা আছে। আগুনে ছাড়লে এর গায়ে আগুন লাগবে আর সে দৌড়াবে। ঘুঙুর বাজবে। যত তাড়াতাড়ি দৌড়াবে তত তাড়াতাড়ি ঘুঙুর বাজবে। এইটাই মজা।
আমি হতভম্ব, এরা বলে কী! ছেলেটার কথা শেষ হবার আগেই নান্টু কুকুরছানাটা আগুনে ফেলে দিল। দাউদাউ করে আগুন জ্বলে উঠল। কুকুরছানা দৌড়াল না, এক জায়গায় দাঁড়িয়ে রইল। হয়তোবা মানুষের নিষ্ঠুরতায় হতভম্ব হয়ে গিয়েছিল।
আমি আগুনের উপর লাফিয়ে পড়লাম। আমার শার্টে আগুন ধরে গেল। প্যান্টে আগুন ধরে গেল। এইসব কিছুই গ্রাহ্য করলাম না। আমার একমাত্র চিন্তা বাচ্চাটাকে আগুন থেকে বের করতে হবে।
আলিমুজ্জামান সাহেব থামলেন।
আমি বললাম, বের করতে পেরেছিলেন?
হ্যাঁ।
বাচ্চাটা বেঁচেছিল?
না বাঁচেনি। বাঁচার কথাও না। আমার গায়ে থার্ড ডিগ্রি বার্ন হয়ে গেল। কুমিল্লা মেডিক্যালে কিছুদিন থাকলাম, তারপর আমাকে পাঠানো হলো ঢাকা মেডিক্যাল কলেজে। দুমাসের ওপর হাসপাতালে থাকতে হবে। এক পর্যায়ে ডাক্তাররা আমাকে বাঁচানোর আশা ছেড়েই দিয়েছিলেন। সেই সময় বার্ন-এর চিকিৎসার তেমন ব্যবস্থা ছিল না। স্কিন গ্রাফটিং হতো না। অল্পতেই শরীরে ইনফেকশন হয়ে যেত। যা-ই হোক, বেঁচে গেলাম, তবে সেই বছর পরীক্ষা দিতে পারলাম না।