আমি মনের বিরক্তি গোপন করার প্রাণপণ চেষ্টা করতে করতে বললাম, জী ভালো আছি।
ভদ্রলোক হাসিমুখে বললেন, বসব খানিকক্ষণ?
জী বসুন। আমি অবশ্যি কিছুক্ষণের মধ্যেই বেরুব।
আমাকে কি চিনতে পারছেন?
জী না।
ঐ যে মোড়ের সিগারেটের দোকানের সামনে আলাপ হলো। আপনি সিগারেট কিনছিলেন, আমি পান।
আমি ভদ্রলোককে চিনতে পারলাম না। মোড়ের পানের দোকানে সামান্য আলাপের পর সারাজীবন চিনে রাখব আমার স্মৃতিশক্তি এত ভালো নয়। ভদ্রলোক হাসিমুখে বললেন, আমার নাম আলিমুজ্জামান। পোস্টাল সার্ভিসে ছিলাম, তিন বছর আগে রিটায়ার করেছি। এইটথ মে মঙ্গলবার। এখন ঘরেই থাকি, একটা বাগান করেছি।
ভালো, খুবই ভালো।
ভদ্রলোক সোফায় বসেছেন। কৌতূহলী চোখে চারদিক দেখছেন। বারবার আমার বইয়ের আলমিরায় তাঁর চোখ আটকে যাচ্ছে। আমি শঙ্কিত বোধ করছি। এখনই হয়তো বলবেন, আপনার তো অনেক বই, কয়েকটা নিয়ে যাই। পড়ে ফেরত দেব।
আমি এখন পর্যন্ত কাউকে দেখিনি যে বই পড়ে ফেরত দেয়। ইনিও দেবেন তা মনে হয় না। বই নেয়ার ছুতায় রোজ এসে বিরক্ত করবেন। আমি এমন কোনো মিশুক লোক না যে এই বুড়োমানুষটির সঙ্গ পছন্দ করব।
প্রফেসর সাহেব, আপনি কি ভূত-প্রেত এইসব বিশ্বাস করেন?
জী না, করি না।
শুনে ভালো লাগল। আজকাল শিক্ষিত লোক দেখি এইসব বিশ্বাস করে। মনটা খারাপ হয়। মানুষ চাঁদে যাচ্ছে সেটা বিশ্বাস করছে আবার ভূতও বিশ্বাস করছে। ফিজিক্সের এক প্রফেসরের হাতে দেখেছি চারটা পাথরের আংটি।
আমি চুপ করে রইলাম। আমার কাছ থেকে উত্তর না পেলে ভদ্রলোকের আলাপের উৎসাহ হয়তো কমে যাবে। তিনি বিদায় হবেন।
প্রফেসর সাহেব!
জী।
আপনি কি কো-ইনসিডেন্সে বিশ্বাস করেন?
আপনার প্রশ্নটা ঠিক বুঝতে পারলাম না।
কাকতালীয় ঘটনা।
আমি এখনও আপনার প্রশ্নটা বুঝতে পারছি না।
আরেকদিন আপনাকে বলব, আজ মনে হচ্ছে আপনি একটু বিরক্ত। তবে ঘটনাটা বলা শুরু করলে আপনার বিরক্তি কেটে যেত।
আমি ভদ্রলোকের কথায় সত্যিকার অর্থেই লজ্জিত বোধ করলাম। আমি বিরক্ত নিশ্চয়ই হয়েছি, কিন্তু সেই বিরক্তি উনি ধরে ফেলবেন তা বুঝতে পারিনি। রিটায়ার্ড মানুষ। একা একা থাকেন। কথা বলার সঙ্গী তো তাঁদেরই দরকার।
প্রফেসর সাহেব উঠি।
উঠবেন?
জী। আজকাল কোথাও বেশিক্ষণ বসি না। রিটায়ার্ড মানুষদের কেউ পছন্দ করে না। সবাই ভাবে সময় নষ্ট করার জন্যে গিয়েছি। তা ছাড়া মানুষদের সঙ্গ আমি নিজেও যে খুব পছন্দ করি তা না।
আপনি আসবেন, আপনার সঙ্গে গল্প করব। কোনো অসুবিধা নেই। আজ অবশ্যি একটু ব্যস্ত।
গল্পগুজব আমি তেমন পারি না। কো-ইনসিডেন্সের একটা ব্যাপার আমার জীবনে আছে— ঐ গল্পটা ছাড়া আমি কোনো গল্প জানি না। গল্পটা খুব ব্যক্তিগত, এই জীবনে অল্প কয়েকজনকে বলেছি। আপনাকে কেন জানি বলার ইচ্ছা করছিল।
অবশ্যই বলবেন।
আপনি যদি দয়া করে একটু বারান্দায় আসেন তাহলে আমার বাসাটা আপনাকে দেখাতাম, হঠাৎ কোনো একদিন চলে এলে ভালো লাগত!
আমি বারান্দায় এসে দাঁড়ালাম। ভদ্রলোক হাত উঁচু করে দেয়াল দিয়ে ঘেরা একতলা একটি বাড়ি দেখালেন। পুরনো বাড়ি। দোতলার কাজ শুরু করা হয়েছিল শেষ হয়নি। বাড়ির সামনে দুটা জড়াজড়ি কাঁঠাল গাছ।
একদিন যদি আসেন আপনার ভালো লাগবে। আমার জীবনের কোইনসিডেন্সের ঘটনাটাও শুনবেন।
জী আচ্ছা একদিন যাব।
আমার নামটা আপনার মনে আছে তো?
জী আছে।
নামটা বলুন তো!
আমি দ্বিতীয়বার লজ্জা পেলাম। কারণ ভদ্রলোকের নাম কিছুতেই মনে করতে পারলাম না।
ভদ্রলোকের স্বভাবও এমন বিচিত্র যে আমার লজ্জা বুঝতে পেরেও জবাবের জন্যে মাথা নিচু করে অপেক্ষা করতে লাগলেন।
নামটা বোধহয় আপনার মনে পড়ছে না তা-ই না?
জী না।
মনে থাকার কথাও না। আনকমন নাম মানুষের মনে থাকে। আমার নাম খুবই কমন— আলিমুজ্জামান। একদিন আসবেন আমার বাসায় দয়া করে। ঘটনাটা বলব, শুনতে আপনার খারাপ লাগবে না।
জী আচ্ছা, আমি যাব। খুব শিগগিরই একদিন যাব।
এক বৃহস্পতিবার বিকেলে ভদ্রলোকের বাসায় উপস্থিত হলাম। গল্প শোনার আগ্রহে নয়, লজ্জা কাটানোর জন্যে। ভদ্রলোক ঐদিন আমাকে খুব লজ্জায় ফেলেছিলেন।
বাসায় ঢুকে আমার বিস্ময়ের সীমা রইল না। সাধারণ একটা বসার ঘর। বেতের কয়েকটা চেয়ার। দেয়ালজুড়ে বইয়ের আলমিরা। খুব কম করে হলেও হাজার পনেরো বই ভদ্রলোকের সংগ্রহে আছে। কারো ব্যক্তিগত সংগ্রহে এত বই থাকে আমার জানা ছিল না। নিজের অজান্তেই আমি বললাম–অপূর্ব!
ভদ্রলোক হাসিমুখে বললেন–বলেছিলাম না আমার বাসায় এলে আপনার ভালো লাগবে।
আপনার বইয়ের সংখ্যা কত?
ষোলো হাজারের কিছু বেশি। আমার শোবার ঘরেও বেশকিছু বই। আপনাকে দেখাব।
সব আপনার নিজের সংগ্রহ?
আমার বাবার সংগ্রহ অনেক আছে। বই কেনার বাতিক বাবার কাছ থেকে পেয়েছি। খুব বইপাগল লোক ছিলেন। খুব বই পড়তেন। আমি তাঁর মতো পড়তে পারি না। অনেক বই আছে, আমি কিনে রেখেছি, এখনও পড়িনি।
এখন তো প্রচুর অবসর। এখন নিশ্চয় পড়ছেন।
আমার চোখের সমস্যা আছে। খুব বেশিক্ষণ একনাগাড়ে পড়তে পারি না। আমি খুব খুশি হব যদি আমার লাইব্রেরি থেকে বই নিয়ে আপনি পড়েন। বই তো পড়ার জন্যেই। আলমিরায় সাজিয়ে রাখার জন্যে না।
আপনি কি সবাইকে বই পড়তে দেন?
জী দিই।
তারা বই ফেরত দেয়?
অনেকেই দেয় না। সেইসব পরে কিনে ফেলি। আমার সংসার ছোট। একটামাত্র মেয়ে, স্ত্রী মারা গেছেন। সংসারের তুলনায় টাকা-পয়সা ভালোই আছে। বই কেনায় একটা অংশ ব্যয় করি। আপনি ঘুরে ঘুরে বই দেখুন, আমি চা নিয়ে আসছি।