আবার চেয়ার নড়ল। নিশ্চয়ই মনের ভুল।
নাসরিনের বড় ভয় লাগছে। জুন মাসের এই প্রচণ্ড গরমের রাতেও একটা চাদরে সারা শরীর ঢেকে সে শুয়ে রইল। ঘুম এল একেবারে শেষ রাতে। তাও গাঢ় ঘুম না। আজেবাজে সব স্বপ্ন। একটা স্বপ্ন তো খুবই ভয়ংকর। তার শাড়িতে দাউদাউ করে আগুন জ্বলছে। সে অনেক চেষ্টা করছে আগুন নেভাতে। পারছে না। যতই চেষ্টা করছে আগুন আরো ছড়িয়ে পড়ছে। একজন বুড়োমতো লোক চুরুট-হাতে পুরো ব্যাপারটা দেখছে, কিছুই করছে না।
টাকার পরিমাণ বাড়ানোর দাবি রাহেলা অনেক ভণিতার পর করলেন। বলতে তাঁর খুবই লজ্জা লাগল, কিন্তু কোনো উপায় নেই।
আলাউদ্দিন তখন চা খাচ্ছিল। চায়ের কাপ নামিয়ে বিস্মিত গলায় বলল, টাকা বাড়াতে বলছ?
হ্যাঁ।
একশো ডলারে তোমাদের হচ্ছে না?
না।
তোমরা কি পাগল-টাগল হয়ে গেলে? আমেরিকায় কি আমি টাকার চাষ করছি? ট্রাকটার দিয়ে জমি চষে টাকার চারাগাছ বুনে দিচ্ছি?
রাহেলা ক্ষীণস্বরে বললেন, সংসার অচল।
সংসার তো আমারটা আরো বেশি অচল। বিয়ে করেছি— নতুন সংসার। অ্যাপার্টমেন্ট নিয়েছি। একটা জিনিস নেই অ্যাপার্টমেন্টে। ক্লারা অফিস করে, তার একটা আলাদা গাড়ির দরকার। তোমাদের টাকা তো বাড়াতে পারবই না, বরং কিছু কমিয়ে দেব বলে ভাবছি।
আমাদের চলবে কীভাবে?
জসিম ভাইকে বলো। তারও তো কিছু দায়িত্ব আছে। সে তো গায়ে ফুঁ দিয়ে ঘুরছে।
রাহেলা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। আলাউদ্দিন বিরক্ত স্বরে বলল, এরকম ঘন ঘন দীর্ঘনিশ্বাস ফেলবে না মা। নিশ্বাস ফেলে সমস্যার সমাধান হয় না।
৩.
নাসরিন ওইজা বোর্ড নিয়ে বসেছে। রাত প্রায় দুটো। আজ অন্যদিনের মতো গরম নয়। সন্ধ্যাবেলায় তুমুল বর্ষণ হয়েছে। আকাশ মেঘলা। বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে। আবারও হয়তো বৃষ্টি হবে। বৃষ্টির ছাঁট আসছে বলে জানালা বন্ধ।
আপনি কি আছেন?
হ্যাঁ।
আমাদের কী বিপদ হয়েছে শুনেছেন?
ভাইয়া টাকা-পয়সা বেশি তো পাঠাবেই না; বরং আরো কমিয়ে দেবে।
ও আচ্ছা।
কী করব আমরা বলুন তো?
মেয়েটাকে মেরে ফ্যালো।
এইটা ছাড়া বুঝি আপনার মাথায় আর বুদ্ধি নেই?
না। এটা সবচেয়ে ভালো বুদ্ধি।
আপনার সঙ্গে আমার কথা বলতেই ইচ্ছা করছে না।
শুনে দুঃখিত হলাম।
আচ্ছা ঐদিন আপনি আমাকে ভয় দেখালেন কেন? আপনি কি ঐ চেয়ারটায় বসেছিলেন? আমার মনে হয় আপনি এখনও চেয়ারটায় বসে আছেন।
ক্লারাকে আগুনে পুড়িয়ে মারলে কেমন হয়?
আপনি আজেবাজে কথা বলবেন না তো! আচ্ছা বলুন তো ঐদিন কি আপনি চেয়ারে বসেছিলেন?
তুমি একটু সাহায্য করলেই হয়।
কী সাহায্য?
যখন আগুন জ্বলে উঠবে তখন এই ঘরের দরজা তুমি বাইরে থেকে বন্ধ করে দেবে।
আপনার কথাবার্তার আগামাথা কিছুই বুঝতে পারছি না।
আগুন লাগার পর মেয়েটা যাতে বেরুতে না পারে।
কী বলছেন আপনি?
আগুন লাগার পর সে ছুটে বের হতে চাইবে। তখন তাকে শুধু আটকানো। অল্প কিছুক্ষণ আটকে রাখা।
চুপ করুন তো!
ভালো বুদ্ধি দিচ্ছি।
আপনার বুদ্ধি চাই না।
তুমি আমার বন্ধু।
না, আমি আপনার বন্ধু নই।
আজ রাতে নাসরিন এক পলকের জন্যেও চোখ এক করতে পারল না। মনে মনে ঠিক করে ফেলল ওইজা বোর্ডটা ভোর হতেই আগুন দিয়ে পুড়িয়ে ফেলবে। কী সর্বনাশের কথা! বোতামটা এমন অদ্ভুত কথা বলছে কেন?
৪.
আগামীকাল রাত দুটার ফ্লাইটে আলাউদ্দিন চলে যাবে। শেষ রাতটা এ বাড়িতে থাকবার জন্যে এসেছে, দীর্ঘদিন হোটেলে থাকায় তাকে বেশ লজ্জিতও মনে হচ্ছে।
আজ রাতটা থাকতে তেমন কষ্ট হবে না। বর্ষা শুরু হয়ে গেছে। আবহাওয়া অসহনীয় নয়। ঝুম বৃষ্টি হচ্ছে।
আলাউদ্দিন বসার ঘরে সবার সঙ্গে গল্প করছে। গল্প বেশ জমে উঠেছে। প্রথমদিকে আমেরিকায় সে কীসব বিপদে পড়েছিল তার গল্প। প্রতিটি গল্পই আগে অনেকবার শোনা তবু সবাই খুব আগ্রহ করে শুনছে।
ঘরে ইলেকট্রিসিটি নেই। বিকেলে ঝড়বৃষ্টির সময় ইলৈকট্রিসিটি চলে গিয়েছে, এখনও আসেনি। আজ রাতে আর আসবে বলে মনে হয় না। ঝড়বৃষ্টি এখনও হচ্ছে। বাতাসের শোঁ শোঁ শব্দ, বৃষ্টির ঝমঝমানি, দমকা হাওয়ার ঝাঁপটা, চমৎকার পরিবেশ।
একটিমাত্র হারিকেন, সেটা বসার ঘরে। হারিকেন ঘিরে সবাই বসে আছে।
ক্লারা ওদের গল্পে কোনো মজা পাচ্ছিল না, ঘন ঘন হাই তুলছিল। মাঝরাতে সে ঘুমুতে গেল। নাসরিন তার ঘরে মোমবাতি জ্বালিয়ে দিয়ে গেল।
।দুর্ঘটনা ঘটল তারও মিনিট দশেক পর, গল্প তখন খুব জমে উঠেছে। শুরু হয়েছে ভূতের গল্প। রাহেলা ছোটবেলায় নিশির ডাক শুনে ঘর ছেড়ে বের হয়ে পড়েছিলেন সেই গল্প হচ্ছে। গা ছমছমানো পরিবেশ। ঠিক তখন তীক্ষ্ণ গলায় নাসরিন বলল, ঘর এত আলো হয়ে গেছে কেন ভাইয়া? তার কথা শেষ হবার আগেই শোনা গেল গোঙানি ও চিৎকার। দরজায় ধাক্কা দিচ্ছে এবং ক্লারা চ্যাঁচাচ্ছে–Oh God, Oh Good.
সবাই ছুটে গেল শোবার ঘরের দিকে। দাউদাউ করে আগুন জ্বলছে।
দুর্ঘটনা তো বটেই। দুর্ঘটনা ছাড়া কিছুই নয়। বাতাসে মোমবাতি কাত হয়ে পড়ে গিয়েছিল নেটের মশারিতে। সেখান থেকে ক্লারার নাইট গাউনে। সিনথেটিক কাপড় মুহূর্তের মধ্যে জ্বলে উঠল। খুবই সহজ ব্যাখ্যা। শুধু একটি ব্যাপার ব্যাখ্যা করা যাচ্ছে না। ক্লারার ঘরের দরজা বাইরে থেকে বন্ধ ছিল। কেউ একজন বাইরে থেকে শিকল তুলে দিয়েছিল। আগুন লেগে যাবার পর ক্লারা প্রাণপণ চেষ্টা করেছে ঘর থেকে বেরুতে। বেরুতে পারেনি। চিৎকার করে দরজা খুলতে বলেছে— ঝড়-বৃষ্টি এবং বজ্রপাতের সঙ্গে তার চিৎকারও কেউ শোনেনি। ব্যাকুল হয়ে শেষ মুহূর্তে সে ঈশ্বরকে ডাকছিল। ঈশ্বর মানুষের কাতর আহ্বানে সাধারণত বিচলিত হন না।
কুকুর
কেমন আছেন প্রফেসর সাহেব?