নাসরিনের মুখ কালো হয়ে গেল।
মনসুর সাহেব মেয়েকে রক্ষা করার জন্যে বললেন, একবার মাত্র খেয়েছে কিছু হবে না। আমরা তো সব সময় খাচ্ছি।
তোমাদের খাওয়া আর ক্লারার খাওয়া এক হলো? মাইক্রো অরগেনিজম খেয়ে খেয়ে তোমরা ইমমিউন হয়ে আছ। ও তো হয়নি।
যা হবার হয়ে গেছে। এখন চিৎকার করে আর কী হবে?
চিৎকার করছি নাকি? তোমাদের সঙ্গে দেখি সামান্য আরগুমেন্টও করা যায় না!
নাসরিন অনেক চেষ্টা করেও কান্না আটকাতে পারল না। মুখে শাড়ির আঁচল গুঁজে দ্রুত বের হয়ে গেল। রাহেলা মৃদুস্বরে বললেন, দিলি তো মেয়েটাকে কাঁদিয়ে! যা অভিমানী মেয়ে! রাতে তো খাবেই না।
আলাউদ্দিন বিরক্ত গলায় বলল, এত অল্পতেই যদি চোখে পানি এসে যায় তা হলে তো মুশকিল। একটা ভুল করলে তার ভুল ধরিয়ে দেয়া যাবে al?
ও ছেলেমানুষ।
ছেলেমানুষ কী বলছ? সতেরো আঠারো বছরের কেউ ছেলেমানুষ থাকে? তোমাদের জন্যে বড় হতে পারে না। তোমরা ছেলেমানুষ বানিয়ে রেখে দাও।
আলাউদ্দিন রাতে খেল না। বউকে নিয়ে নাকি নিরিবিলি কোথাও ডিনার করবে।
নাসরিন সেই রাতে ঘুমুতে গেল না-খেয়ে। অনেকক্ষণ জেগে রইল, ঘুম এল না। তার খুব কষ্ট হচ্ছে। মরে যেতে ইচ্ছা করছে। অনেক রাতে সে ওইজা বোর্ড নিয়ে বসল। আজ আর দেরি হলো না। বোতামে হাত রাখামাত্র বোতাম নড়তে লাগল। আজ সে উত্তরগুলিও শুধু হ্যা বা না দিয়ে দিচ্ছে না। অক্ষরের উপর ঘুরে ঘুরে ছোট ছোট শব্দ তৈরি করছে। মজার মজার শব্দ। নাসরিন এই শব্দগুলিকে গুরুত্ব দিচ্ছে না আবার গুরুত্ব দিচ্ছে। একবার ভাবছে–এগুলি অবচেতন মনের ইচ্ছে, আরেকবার ভাবছে— হতেও তো পারে। হয়তো সত্যি কেউ এসেছে। পৃথিবীতে রহস্যময় ব্যাপারটা তো হয়। কটা রহস্যের সমাধান আমরা জানি? কী যেন বলেছেন শেকসপিয়ার— There are many things….
আপনি কি এসেছেন?
হ্যাঁ।
কাল যিনি এসেছিলেন আজও কি তিনিই এসেছেন?
হ্যাঁ।
আপনার নাম?
X
কী অদ্ভুত নাম! আচ্ছা আপনি কি জানেন আজ আমার মন কালকের চেয়েও খারাপ?
জানি।
কী করা যায় বলুন তো?
আমি জানি না।
আপনি কি জানেন আপনার সঙ্গে কথা বলতে আমার খুব ভালো লাগে।
জানি।
ভাইয়া বলছিল এই যে আপনি নানান কথা বলছেন এগুলি আসলে আমার মনের অবচেতন ইচ্ছার প্রতিফলন।
হতে পারে।
ভাইয়াকে আমার দারুণ পছন্দ। আমি জানি।
ঐ পচা মেয়েটা সব নষ্ট করে দিয়েছে। আমার মনে হয় মেয়েটা ডাইনি। ও আশপাশে থাকলেই ভাইয়া অন্যরকম হয়ে যায়। তখন সবার সঙ্গে ঝগড়া করে।
জানি।
কী করা যায় বলুন তো।
মেয়েটাকে মেরে ফ্যালো।
ছিঃ, কী যে বলেন! মানুষকে মেরে ফেলা যায় নাকি?
হ্যাঁ, যায়।
কীভাবে?
অনেকভাবে।
আপনার কথাবার্তার কোনো ঠিক নেই। আপনি কী করে ভাবলেন আমি একটা মানুষ মারতে পারি?
সবাই পারে।
আপনি পারেন?
না।
আপনি পারেন না কেন?
আমি জানি না।
মানুষ মারা যে মহাপাপ এটা কি আপনি জানেন?
আমি জানি না।
আপনি আসলে কিছুই জানেন না।
হতে পারে।
তা ছাড়া আপনি আরেকটা জিনিস ভুলে যাচ্ছেন। ধরুন আমি ঐ পচা মেয়েটাকে মেরে ফেললাম, তখন পুলিশ আমাকে ছেড়ে দেবে? আমাকে ধরে নিয়ে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে দেবে না?
তা দিতে পারে।
আর ভাইয়ার অবস্থাটা তখন চিন্তা করে দেখুন। কীরকম রাগ সে করবে। টাকা-পয়সা দেয়া বন্ধ করে দেবে। আমরা তখন না-খেয়ে মারা যাব। বাবার এক পয়সা রোজগার নেই, আমাদের ব্যাংকে টাকা-পয়সা নেই। ভাইয়া প্রতি মাসে যে টাকা পাঠায় এটা দিয়ে আমরা চলি। ভাইয়া প্রতি মাসে কত পাঠায় বলুন তো?
আমি জানি না।
একশো ডলার। একশো ডলারে বাংলাদেশী টাকায় কত হয় তা জানেন?
না।
বেশি না, সাড়ে তিন হাজার। মা এবার কী ঠিক করে রেখেছেন জানেন? মা ঠিক করে রেখেছেন— ভাইয়াকে বলবেন আরো কিছু বেশি টাকা পাঠাতে। একশো ডলারে হচ্ছে না। জিনিসপত্রের যা দাম। আপনাদের তো আর কোনোকিছু কিনতে হয় না। আপনারা আছেন সুখে, তা-ই না?
আমি জানি না।
আচ্ছা আপনার কী মনে হয় ভাইয়া টাকার পরিমাণ বাড়াবে?
আমি জানি না।
না বাড়ালে আমাদের খুব কষ্টের মধ্যে পড়তে হবে। আমার কেন জানি মনে হচ্ছে বাড়াবে না। বিয়ে করেছে, খরচ বেড়েছে। তাই না?
হতে পারে।
টাকা না বাড়ালে কী হবে বলুন তো! আমার আরেক ভাই আছেনজসিম ভাইয়া। চিটাগাঙে থাকেন। তাঁর টাকা-পয়সা ভালোই আছে। কিন্তু সে আমাদের একটা পয়সা দেয় না। আমরা যদি না খেয়ে মরেও যাই সে ফিরে তাকায় না। কী করা যায় বলুন তো?
ক্লারাকে মেরে ফেলা যাক।
বারবার আপনি এক কথা বলেন কেন? আপনার কাছে বুদ্ধি চাচ্ছি।
ক্লারাকে মেরে ফেলাই একমাত্র বুদ্ধি।
যান। আপনার সাথে আর কথাই বলব না।
নাসরিন ওইজা বোর্ড বন্ধ করে ঘুমুতে গেল। আজ আর গতরাতের মতো চট করে ঘুম এল না। একটু যেন ভয়-ভয় করতে লাগল। ওইজা বোর্ড টেবিলের ওপর রাখা হয়েছে। তার কাছেই একটা চেয়ার। নাসরিনের কেন জানি মনে হচ্ছে চেয়ারে ঐ মি. এক্স বসে আছেন। বুড়ো ধরনের একজন মানুষ, যার গায়ে চুরুটের গন্ধ। ঐ বুড়ো মানুষটার একটা চোখে ছানিপড়া। গায়ে চামড়ার কোট। সেই কোটেও এক ধরনের ভ্যাপসা গন্ধ।
নাসরিন কাউকে দেখতে পাচ্ছে না। কিন্তু তার স্পষ্ট মনে হচ্ছে কেউএকজন আছে।
নাসরিন ভয়ে-ভয়ে বলল, আপনি কি আছেন? চেয়ার নড়ে উঠল। সত্যি নড়ল? না মনের ভুল? নাসরিন ক্ষীণ স্বরে বলল, আপনি দয়া করে বসে থাকবেন না। চলে যান। যখন আপনাকে দরকার হবে আমি ডাকব।