ভূত নামালে কেমন হয়? ওইজা বোর্ড খুলে সে যদি বোতামটা হাত দিয়ে ছুঁয়ে বসে থাকে তা হলে কি কিছু হবে? যদি কোনো আত্মা চলে আসে ভালোই হয়। আত্মার সঙ্গে গল্প করা যাবে। মুশকিল হচ্ছে এই আত্মাগুলি আবার কথা বলে না। বোম ঠেলে ঠেলে মনের ভাব প্রকাশ করে।
নাসরিন দরজা বন্ধ করে ওইজা বোর্ড নিয়ে বসল। তর্জনী দিয়ে বোতামটা হাত দিয়ে ছুঁয়ে নরম গলায় বলল, আমার আশপাশে যদি কোনো বিদেহী আত্মা থাকেন তা হলে তাঁদের মধ্যে একজন কি দয়া করে আসবেন? যদি আসেন তা হলে আমার মনটা একটু ভালো হবে। কারণ আজ আমার মনটা খুব খারাপ। কেন খারাপ তা তো আপনারা খুব ভালো করেই জানেন। পুরো ঘটনার সময় নিশ্চয়ই আপনারা আশপাশে ছিলেন। ছিলেন না? এই পর্যন্ত বলেই নাসরিন চমকে উঠল। ডান হাতটা একটু যেন কাঁপছে।
বোতামটা কি নড়তে শুরু করেছে? অসম্ভব, হতেই পারে না। এ কী, বোতামটা এগিয়ে গেল কীভাবে? নাসরিন নিজেই হয়তো নিজের অজান্তে বোতাম ঠেলে ঠেলে নিয়ে গেছে। খানিকটা ভয় এবং খানিকটা অস্বস্তি নিয়ে নাসরিন অপেক্ষা করছে। হচ্ছেটা কী?
বোতাম ইয়েস লেখা ঘরে কিছুক্ষণ থেমে আবার আগের জায়গায় ফিরে এল। নাসরিন শব্দ করেই বলল, বাহ বেশ মজা তো! পরবর্তী কিছুক্ষণ ইয়েস এবং নাতে বোম ঘুরতে লাগল। নাসরিনের শুরুর
ভয় খানিকটা কমে গেল। যদিও তখনও বুক ধক ধক করছে।
ওইজা বোর্ডে ইয়েস এবং না ছাড়া আরো দুটি ঘর আছে সেগুলি হচ্ছে–আমি উত্তর দেব না, আমি জানি না। বোতামটা এইসব ঘরেও মাঝে মাঝে এল। প্রশ্ন এবং উত্তর এইভাবে সাজানো যায়
আপনি কি এসেছেন?
হ্যাঁ।
আপনি কি এই বাড়িতেই থাকেন?
না।
আপনি কোথায় থাকেন?
আমি উত্তর দেব না।
আজ আমাদের সবার খুব মন-খারাপ সেটা কি আপনি জানেন?
না।
কীজন্যে আমাদের মন খারাপ সেটা কি বলব?
না।
শুধু না-না করছেন কেন? একটু শুনলে কী হয়? বলি?
হ্যাঁ।
তার আগে বলুন আপনার নাম কী?
বোতামটা ঘুরতে ঘুরতে এক্স ঘরে গিয়ে থামল। নাসরিন বলল, এক্স দিয়ে বুঝি কারোর নাম হয়? ঠিক করে নাম বলুন।
আমি জানি না।
আপনি জানেন না মানে? আপনার কি নাম নেই?
না।
ভূতদের নাম থাকে না?
আমি জানি না।
সে কী, আমার তো ধারণা প্রেতাত্মারা সব জানে। আর আমি আপনাকে যাই জিজ্ঞেস করছি— আপনি বলছেন আমি জানি না। আচ্ছা বলুন তো উনিশকে তিন দিয়ে গুণ দিলে কত হয়?
আমি জানি না।
আমি জানি না।
তবে আপনি যদি বলতেন তা হলে গুণ করে বের করতাম। আপনি কি গুণ অংক জানেন?
হ্যাঁ। আচ্ছা আত্মাদের কি অংক করতে হয়?
বোতাম এক জায়গায় স্থির হয়ে রইল। উত্তর দিল না। নাসরিন বলল, আপনি কি আমার ওপর রাগ করেছেন?
হ্যাঁ।
প্লিজ আমার ওপর রাগ করবেন না। কেউ আমার সাথে রাগ করলে আমার খুব মন-খারাপ থাকে। এমনিতেই আজ আমার খুব মন-খারাপ। আপনি কি জানেন আমার যে মন-খারাপ?
হ্যাঁ।
কেন মন-খারাপ সেই ঘটনাটা বলি? বলব?
হ্যাঁ।
নাসরিন আজ সারাদিনের ঘটনা বলতে শুরু করল। বলতে বলতে দুবার কেঁদে ফেলল। তার কাছে একবারও মনে হলো না সে হাস্যকর একটা কাণ্ড করছে। এইসব গল্প বোতামটাকে বলার কোনো মানে আছে?
নাসরিন ঘুমুতে গেল রাত তিনটায়। খুব চমৎকার ঘুম হলো। ঘুমিয়ে এত তৃপ্তি অনেকদিন সে পায়নি। তবে ঘুমের মধ্যে সারাক্ষণই মনে হলো একজন বুড়োমানুষ তার গায়ে হাত রেখে শুয়ে আছেন। বুড়োমানুষটার শরীরে চুরুটের কড়া গন্ধ।
২.
ভোর সাতটায় আলাউদ্দিন এসে উপস্থিত।
সে ভোর হতেই বাসায় চলে আসবে রাহেলা তা ভাবেননি। আগের রাতের সব দুঃখ তিনি ভুলে গেলেন। হাসিমুখে বললেন, বউমাকে আনলি না।
ও ঘুমুচ্ছে। ঘুম ভাঙলে চলে আসবে। নোট লিখে এসেছি।
আসতে পারবে একা একা?
আসতে পারবে না মানে? কী যে তুমি বল মা! ও কি আমাদের দেশের মেয়ে যে স্বামী ছাড়া এক পা ফেলতে পারে না!
তা তো ঠিকই।
রাহেলা নাশতার আয়েজনে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন। আলাউদ্দিনকে এখন সহজ ও স্বাভাবিক মনে হচ্ছে। রান্নাঘরে মার পাশে বসে অনেক গল্প করতে লাগল। নাসরিন এবং মনসুর সাহেবও গল্পে যোগ দিলেন।
তুই তো ঐ দেশেই থেকে যাবি?
হ্যাঁ। এই দেশে আছে কী বলো? এই দেশে থাকলে তো মরতে হবে না-খেয়ে।
অনেকেই তো আছে।
কীরকম আছে তা তো দেখতেই পাচ্ছি।
তাও ঠিক।
নাসরিনও সহজভাবে ভাইয়ের সঙ্গে অনেক গল্প করল। এখন ভাইয়াকে খুব আপন লাগছে। কথা বলতে ভালো লাগছে।
ভাইয়া, কাল ওইজা বোর্ড দিয়ে ভূত এনেছিলাম।
তা-ই নাকি?
হ্যাঁ। আপনাআপনি বোতাম এক ঘর থেকে অন্য ঘরে যায়।
তুই নিশ্চয়ই ঠেলেছিস।
অনেস্ট ভাইয়া। মোটেই ঠেলিনি।
তুই না ঠেললেও তোর সাবকনশাস মাইন্ড ঠেলেছে। আমি নিউজ উইক পত্রিকায় দেখেছিলাম। পুরো ব্যাপারটাই আসলে সাব-কনশাস মাইন্ডের।
এমন সহজ স্বাভাবিকভাবে যে মানুষটা গল্প করল সেই আবার ঠিক সন্ধ্যাবেলা একটা ঝগড়া বাধিয়ে বসল। সাধারণ ঝগড়া না— কুৎসিত ঝগড়া। ব্যাপারটা এরকম।
ক্লারা খাবার পানি চেয়েছে।
নাসরিন গ্লাসে করে পানি দিয়েছে। এক চুমুকেই সেই পানি খেয়ে ক্লারা বলল–থ্যাংকস। খুব বালো পানি।
ক্লারা এখন কিছু কিছু বাংলা বলার চেষ্টা করে।
আলাউদ্দিন বলল, ফোটানো পানি দিয়েছিস তো? বয়েলড ওয়াটার?
না ভাইয়া। ট্যাপের পানি।
কেন? তোদের কি আগে বলিনি সবসময় বয়েলড পানি দিবি? পানি ফুটিয়ে পরে বোতলে ভরে রাখবি। সামান্য কথাটা মনে থাকে না? বয়স যত বাড়ছে তোর বুদ্ধি দেখি তত কমছে!