কিছুক্ষণের মধ্যেই দ্বিতীয় সমস্যা দেখা দিল–হঠাৎ করে কনট্রেকশান বন্ধ হয়ে গেল। অথচ এই সময়ই কনট্রেকশান সবচে বেশি প্রয়েজন। শিশুটি কি বার্থ চ্যানেলে মারা গেছে?
রুগিণী ফিসফিস করে বলল, আমার ঘুম পাচ্ছে। ঘুমে আমার চোখ বন্ধ হয়ে আসছে।
ডাক্তার সেন ফোরসেপ ডেলিভারির প্রস্তুতি নিলেন আর তখন ইলেকট্রিসিটি চলে গেল। আজকাল বাতি চলে গেলেই ইমার্জেন্সি বাতি জ্বলে ওঠে, তখনকার অবস্থা তা ছিল না। তবে আমাদের কাছে টর্চ, হ্যাজাক, মোমবাতি সবসময় থাকে। সমস্যার সময় ইলেকট্রিসিটি চলে যাওয়া কোনো নতুন ঘটনা নয়–কাজেই প্রস্তুতি থাকবেই। দ্রুত হ্যাজাক জ্বালানো হলো।
প্রায় পঁয়তাল্লিশ মিনিট পরিশ্রম করে ডাক্তার সেন ডেলিভারি করালেন–যে জিনিসটি বেরিয়ে এল, আমরা চোখ বড় বড় করে সেদিকে তাকিয়ে রইলাম।
কুৎসিত কদাকার একটা কিছু যার দিকে তাকানো যায় না। এ আর যা-ই হোক, মানবশিশু নয়। চেনাজানা পৃথিবীর সঙ্গে তার কোনো যোগ নেই। ঘন কৃষ্ণবর্ণের একতাল মাংসপিণ্ড। এর থেকে হাতির শুড়ের মতো আট-দশটি খুঁড় বেরিয়ে এসেছে। শুড়গুলি বড় হচ্ছে এবং ছোট হচ্ছে। তালে তালে মাংসপিণ্ডটিও বড়ছোট হচ্ছে। মানবশিশুর সঙ্গে এর একটিমাত্র মিল— এই জিনিসটিরও দুটি বড় বড় চোখ আছে। চোখ ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে সে দেখছে চারদিকের পৃথিবীকে। চোখ দুটি সুন্দর। কাজলটানা।
ডাক্তার সেন হতভম্ব গলায় বললেন, হোয়াট ইজ দিস? হোয়াই ইজ দিস? ফোরসেপ দিয়ে ধরা জন্তুটাকে তিনি মাটিতে ফেলে দিলেন। মেঝেতে সে কিলবিল করতে লাগল। মনে হচ্ছে শুড়গুলিকে পায়ের মতো ব্যবহার করে সে এগুতে চাচ্ছে। আমার সঙ্গের সহকর্মী হঠাৎ পেটে হাত দিয়ে বমি করতে শুরু করল।
আমাদের পরম সৌভাগ্য যে রুগিণীর জ্ঞান নেই। জ্ঞান থাকলে এই ভয়াবহ দৃশ্য তাকে দেখতে হতো।
ডাক্তার সেন বললেন–কিল ইট। এক্ষুনি এটাকে মেরে ফেলা দরকার।
জন্তটি কি মানুষের কথা বুঝতে পারে? ডাক্তার সেনের কথা শেষ হবার সঙ্গে সঙ্গেই তীব্র ও তীক্ষ্ণ শব্দ বের হয়ে এল। অত্যন্ত হাই ফ্রিকোয়েন্সি সাউন্ড যা মানুষের স্নায়ুকে প্রচণ্ড ঝাঁকিয়ে দেয়।
ডাক্তার সেন বললেন— অপেক্ষা করছেন কেন? কিল ইট।
জন্তুটি এগুতে শুরু করেছে। শুড়গুলি বড় হচ্ছে, ছোট হচ্ছে আর সে এগুচ্ছে তার মার দিকে। আমরা দেখছি সে মেঝে বেয়ে তার মার খাটের দিকে যাচ্ছে। খাট বেয়ে উপরে উঠছে। আশ্রয় খুঁজছে মার কাছে। যেন সে জেনে গেছে এই অকরুণ পৃথিবীতে একজনই শুধু তাকে পরিত্যাগ করবে না।
ডাক্তার সেন বললেন, আপনারা অপেক্ষা করছেন কেন? কিল ইট।
আবার আগের মতো শব্দ হলো। জম্ভটি একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে ডাক্তার সেনের দিকে। তার চোখ দুটি মানুষের চোখ। সেই চোখের ভাষা আমরা জানি। সেই চোখ করুণা এবং দয়া ভিক্ষা করছে। কিন্তু করুণা সে আমাদের কাছ থেকে পাবে না। আমরা মানুষ, আমরা আমাদের মাঝে তাকে গ্রহণ করব না। এই ভয়ংকর অসুন্দর ও কুৎসিতকে আমরা আশ্রয় দেব না। সে পশু হয়ে এলে ভিন্ন কথা ছিল। সে পশু হয়ে আসেনি। মানুষের সিঁড়ি বেয়ে এসেছে।
ডাক্তার সেন বললেন, এই জম্ভটিকে যে মেরে ফেলতে হবে এ বিষয়ে কি আপনাদের কারো মনে কোনো দ্বিধা আছে?
আমরা সবাই বললাম না, আমাদের মধ্যে কোনো দ্বিধা নেই।
ডাক্তার সেন বললেন, আপনারা কি মনে করেন, এই জম্ভটি হত্যার আগে তার আত্মীয়স্বজনদের মত নেয়া উচিত?
আমরা বললাম না, আমরা তাও মনে করি না।
যে লোহার দণ্ডটি থেকে স্যালাইন ওয়াটারের ব্যাগ ঝুলছিল আমি তা খুলে হাতে নিলাম। জন্তুটি এখন তাকিয়ে আছে আমার দিকে। কী সুন্দর বড় বড় শান্ত চোখ! কী আছে ঐ চোখে? ঘৃণা, দুঃখ, হতাশা? জটা খাটের পা বেয়ে অর্ধেক উঠে গিয়েছিল। সেখানেই সে থেমে গেল। বোধহয় বুঝতে পেরেছে আর উঠে লাভ নেই।
প্রথম আঘাতটি করলাম আমি।
সে অবিকল মানুষের মতো গলায় ডাকল— মা, মা।
তার মা সাড়া দিল না।
আমার হাত থেকে লোহার রডটি পড়ে গিয়েছিল। ডাক্তার সেন তা কুড়িয়ে নিয়ে এগিয়ে গেলেন। হত্যাকাণ্ডে বেশি সময় লাগল না।
ডাক্তার হাসনা বানুকে আমি জিজ্ঞেস করেছিলাম। এই ঘটনার কী কোনো ব্যাখ্যা আপনি দাঁড় করাতে পারেন?
ডাক্তার হাসনা ক্লান্ত গলায় বলেছিলেন আমার কাছে কোনো ব্যাখ্যা নেই, তবে এই ঘটনার প্রায় সাত বছর পর আমেরিকান জার্নাল অব মেডিক্যাল সোসাইটিতে এরকম একটি শিশুর জন্মবৃত্তান্তের কথা পাই। শিশুটির জন্ম হয়েছিল বলিভিয়ার এক গ্রামে। শিশুটির বর্ণনার সঙ্গে আমাদের জন্তুটির বর্ণনা হুবহু মিলে যায়। ঐ শিশুটিকেও জন্মের কুড়ি মিনিটের মাথায় হত্যা করা হয় এবং রিপোর্ট অনুসারে সেও মৃত্যুর আগে ব্যাকুল হয়ে বলিভিয়ান ভাষায় মাকে কয়েকবার ডাকে।
আপনার কাছে কোনো ব্যাখ্যা নেই?
না। তবে আমার একটা হাইপোথিসিস আছে। আমার মাঝে মাঝে মনে হয়, প্রকৃতি ইভোলিউশন প্রক্রিয়ায় হয়তো নতুন কোনো প্রাণ সৃষ্টির কথা ভাবছে। পরীক্ষা-নিরীক্ষা করছে। আমরা প্রাণপণে সেই প্রক্রিয়াকে বাধা দিচ্ছি।
আপনার ধারণা এরকম ঘটনা আরো ঘটবে?
হ্যাঁ। প্রকৃতি সহজে হাল ছাড়ে না। সে চেষ্টা চালিয়ে যাবে এবং সে লক্ষ রাখবে যাতে ভবিষ্যতে আমরা বাধা দিতে না পারি। ঐ যে মা আগে স্বপ্ন দেখলেন তার একটিই ব্যাখ্যা প্রকৃতি শিশুটি রক্ষার চেষ্টা করছে। এ ধরনের প্রোটেকশান দেবার চেষ্টা করছে। এখন সে পারছে না। তবে ভবিষ্যতে সে নিশ্চয়ই আরো কোনো ভালো প্রোটেকশানের ব্যবস্থা করবে।