মেয়েটি জবাব দিল না। ব্যথার প্রবল ঝাঁপটা সামলাবার চেষ্টা করল। আমি তাকে সময় দিলাম। আমার মনে হলো মেয়েটা সম্ভবত পুরোপুরি সুস্থ নয়। হয়তো কিছু অস্বাভাবিকতা তার মধ্যে আছে।
তুমি আমার কথা বিশ্বাস করছ না। তাই না?
না।
যা সত্যি তা আমি বললাম।
তুমি জানলে কী করে ওরা বাচ্চাটাকে মেরে ফেলতে চায়?
আমাকে বলেছে।
কে বলেছে?
আমার বাচ্চাটা আমাকে বলেছে।
আমি পুরোপুরি নিঃসন্দেহ হলাম মেয়েটার মাথা খারাপ। সম্ভবত সে পারিবারিক জীবনে খুব অসুখী। শ্বশুরবাড়ির কাউকে তার পছন্দ না। সবাইকেই সে শত্রুপক্ষ ধরে নিয়েছে। মেয়েটি হাঁপাতে হাঁপাতে বলল, তুমি আমার কথা এক বর্ণও বিশ্বাস করনি, তাই না?
তুমি ঠিকই ধরেছ। বিশ্বাস করার কথা না। তোমার বাচ্চা তোমাকে কী করে বলবে।
ও আমাকে স্বপ্নে বলেছে। একবার না, অসংখ্যবার বলেছে।
স্বপ্নে বলেছে?
হ্যাঁ স্বপ্নে। গতকাল শেষরাতেও স্বপ্নে দেখেছি।
কী দেখেছ?
দেখলাম আমার বাচ্চাটা আমাকে বলছে— মা সবাই মিলে আমাকে মেরে ফেলবে। সবাই যুক্তি করে আমাকে মারবে। মা, আমি কী করি?
বলতে বলতে মেয়েটি থরথর করে কাঁপতে লাগল।
আমি তাকে বললাম, প্রথমবার যেসব মেয়ে কনসিভ করে তাদের প্রায় সবাই ভয়ংকর সব স্বপ্ন দেখে। যেমন— তারা মারা যাচ্ছে, মৃত বাচ্চা হচ্ছে— এইসব। এর কোনো মানে নেই। মেয়েরা সেই সময় খুব আতঙ্কগ্রস্ত থাকে বলেই এরকম স্বপ্ন দেখে।
আমি জানি আমি যা স্বপ্নে দেখেছি তা-ই হবে, আমার স্বপ্ন অন্য মেয়েদের স্বপ্নের মতো নয়। সবাই যুক্তি করে আমার ছেলেটাকে মারবে।
আমি হাসতে হাসতে বললাম, তোমার কোলে যখন ফুটফুটে একটা বাচ্চা দিয়ে দেব, তখন তুমি বুঝবে যে কত বড় মিথ্যা সন্দেহ তোমার মধ্যে ছিল।
মেয়েটার চোখ চিকচিক করতে লাগল। সে গাঢ় স্বরে বলল, সত্যি তুমি তা-ই করবে?
অবশ্যই!
তাহলে তুমি প্রতিজ্ঞা করো। কোরান শরিফ ছুঁয়ে বলো তুমি বাচ্চাটাকে মারবে না। ওরা যখন মারতে চাইবে তুমি মারতে দেবে না।
তুমি ফেরাবে।
একটা শিশুকে আমি খুন করব এটা তুমি বলছ?
তুমি কোরান শরিফ ছুঁয়ে প্রতিজ্ঞা করো। প্রতিজ্ঞার কোনো দরকার নেই।
দরকার থাকুক বা না-থাকুক তুমি প্রতিজ্ঞা করো।
কোরান শরিফ এখানে পাব কোথায়?
আমার সঙ্গে আছে। আমার ঐ কালো ব্যাগটার ভেতর। আমি নিয়ে এসেছি।
রুগীকে শান্ত করার জন্যেই প্রতিজ্ঞা করতে হলো। রুগী শান্ত হলো। তার অস্থিরতা আরো বেড়ে গেল। সে চাপাগলায় বলল, আমি জানি তুমি প্রতিজ্ঞা রাখতে পারবে না। যদি না রাখ তাহলে আমার অভিশাপ লাগবে। আমি তোমাকে একটা কঠিন অভিশাপ দিচ্ছি।
মেয়েটি সত্যি সত্যি একটা কঠিন অভিশাপ দিয়ে বসল। মেয়েটার মাথার যে ঠিক নেই, সে যে অসুস্থ একটি মেয়ে তার আরেকটি প্রমাণ পেলাম। তবে তার এই অসুস্থতা, এই মানসিক যন্ত্রণা দীর্ঘস্থায়ী হবে না। একটি হাসিখুশি শিশু তার সমস্ত কষ্ট ভুলিয়ে দেবে।
সবকিছুই ঠিকঠাকমতো চলছিল।
রাত দুটায় বাইরের দুজন পুরুষ-ডাক্তার এলেন। ডেলিভারির সময় এঁরা থাকবেন। এঁদের মধ্যে একজন আমার পরিচিত। ডাক্তার সেন। বড় ডাক্তার এবং ভালো ডাক্তার।
আমাদের রুগিণী নতুন ডাক্তার দুজন দেখেই আতঙ্কে ফ্যাকাশে হয়ে গেল। আমার হাত ধরে ফিসফিস করে বলল, এরা কারা? এরা আমার বাচ্চাকে খুন করবে।
আমি বললাম, তুমি নিশ্চিত থাকে। আমি সারাক্ষণ এখানে থাকব। এক সেকেন্ডের জন্যে নড়ব না। তাছাড়া ডাক্তার সেনকে আমি ব্যক্তিগতভাবে চিনি। তাঁর মতো ডাক্তার কম আছে।
মনে থাকে যেন তুমি প্রতিজ্ঞা করেছ।
আমার মনে আছে।
প্রতিজ্ঞা ভাঙলে আমার অভিশাপ লাগবে।
আমার মনে আছে।
তার কিছুক্ষণ পরই ভদ্রমহিলার স্বামী আমাকে ডেকে নিয়ে গেলেন। খুবই অল্প বয়স্ক একজন যুবক। তাঁকে বেশ দ্র ও বিনয়ী মনে হলো। তবে যে কোনো কারণেই হোক তাকে বেশ ভীত বলে মনে হচ্ছিল। ভদ্রলোক নরম স্বরে বললেন, আপা, আমার স্ত্রী সম্ভবত আপনাকে কিছু বলেছে। আপনি ওর কথায় কিছু মনে করবেন না। ও এসব কেন যে বলছে কিছু বুঝতে পারছি না। আমাদের বাচ্চাটা সংসারের প্রথম সন্তান। আমি আমাদের পরিবারের বড় ছেলে। অথচ ওর ধারণা…
আমি ভদ্রলোককে আশ্বস্ত করার জন্যে বললাম, আপনি এসব নিয়ে মোটেই মাথা ঘামাবেন না।
সব ঠিকঠাক আছে তো আপা?
সব ঠিক আছে।
সিজারিয়ান লাগবে না?
নরম্যাল ডেলিভারি হবে। তাছাড়া ডাক্তার সেন এসেছেন। উনি খুবই বড় ডাক্তার এবং হাইলি স্কিলড।
তাহলে আপনি বলছেন সব ঠিকঠাক হবে?
হ্যাঁ।
রাত তিনটার পর থেকে দেখা গেল সব কেমন বেঠিক চলছে। বাচ্চা নেমে এসেছে বার্থ চ্যানেলের মুখে। এই সময় ডাক্তার সেন বললেন, বাচ্চার পজিশন তো ঠিক নেই। মাথা উপরের দিকে। এতক্ষণ তোমরা কী মনিটর করেছ?
আমিও দেখলাম তাই। এরকম হওয়ার কথা নয়। কিছুক্ষণ আগেই সব পরীক্ষা করা হয়েছে। আমরা মুখ-চাওয়াচাওয়ি করতে লাগলাম। প্রচুর রক্তক্ষরণ হতে লাগল। এই সময় এত রক্তপাতের কারণই নেই। টকটকে লাল রঙের রক্ত যা ধমনি থেকে আসছে। সমস্যাটা কোথায়?
রাড ক্রস ম্যাচিং করা ছিল—–রক্ত দেয়া শুরু হলো, কিন্তু এটা সমস্যার কোনো সমাধান নয়। মনে হলো রুগিণী বাইরের রক্ত ঠিক গ্রহণ করতে পারছে না।
ডাক্তার সেন গম্ভীর গলায় বললেন, সামথিং ইজ ভেরি রং।
আমাদের সবার গা দিয়ে শীতল স্রোত বয়ে গেল। ডাক্তার এসব কী বলছেন!