আমার কথায় একজন ভদ্রমহিলা, সম্ভবত মেয়ের শাশুড়ি হবেন— চোখ-মুখ লাল করে বললেন, আপনি কি জানেন এই মেয়ে কোন বাড়ির TU?
আমি বললাম, আমি জানি না। আমি জানতেও চাই না। সে আমার পেশেন্ট এইটুকু শুধু জানি। আর দশটা পেশেন্টকে আমি যেভাবে দেখব তাকেও একইভাবে দেখা হবে।
আর দশটা বউ এবং আমার ঘরের বউ এক? আমার কাছে এক। জান, আমি এই মুহূর্তে তোমার চাকরি খেতে পারি।
আমি শীতল গলায় বললাম, আপনি আমার চাকরি খেতে পারেন না। চিকিৎসক হিসেবে আমার কোনো ব্যর্থতা পাওয়া গেলে তবেই চাকরি যেতে পারে, তার আগে নয়। আপনি শুধু-শুধুই চাচামেচি করছেন।
ভদ্রমহিলা রেগে গিয়ে স্কাউনড্রেল, লোফার এইসব বলতে লাগলেন। একজন ভদ্রমহিলা এমন কুৎসিত ভাষায় কথা বলতে পারেন আমার জানা ছিল না। বিরাট হইচই বেধে গেল। আমাদের প্রফেসর এলেন। ভেবেছিলাম তিনি আমার পক্ষে কথা বলবেন। তা বললেন না। আমার ওপর অসম্ভব রেগে গেলেন। আমাকে অবাক করে দিয়ে সবার সামনে উঁচু গলায় বললেন-~–হাসনা, তোমাকে এখানে চাকরি করতে হবে না। ইউ ক্যান লিভ।
আমি আমার নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারলাম না। আমার প্রফেসর জানেন কত আগ্রহ, কত যত্ন নিয়ে আমি এখানে কাজ করি; অথচ তিনি…
আমি রিকশা নিয়ে বাসায় চলে এলাম। সহজে আমার চোখে পানি আসে না। কিন্তু রিকশায় ফিরবার পথে খুব কাঁদলাম। তখন বয়স অল্প। মন ছিল খুব স্পর্শকাতর।
রাত এগারোটায় প্রফেসর আমাকে নিতে এলেন। করুণ গলায় বললেন, হাসনা খুব কেলেঙ্কারি হয়ে গেছে। তুমি চলে আসার পর ক্লিনিকের কেউ কোনো কাজ করছে না। অসহযোগ আন্দোলন। এরকম যে দাঁড়াবে কল্পনাও করিনি। এখন তুমি চলল।
আমি বললাম, স্যার আমার যাবার প্রশ্নই ওঠে না। আপনি রুগীর আত্মীয়দের বলুন তাকে অন্য কোনো ক্লিনিকে নিয়ে যেতে।
বলেছিলাম। পেশেন্ট যাবে না। সে এইখানেই থাকবে।
এইখানেই থাকবে?
হ্যাঁ, এইখানেই থাকবে। এবং সে বলে দিয়েছে ডেলিভারির সময় তুমি ছাড়া দ্বিতীয় ব্যক্তি থাকতে পারবে না। এখন তুমি যদি না যাও আমার খুব মুশকিল হবে। আমি খুব বিপদে পড়ব। তুমি তো বাইরের জগতের কোনো খোঁজখবর রাখ না। যদি রাখতে তা হলে বুঝতে এই মেয়ে কোন পরিবারের মেয়ে। বাংলাদেশের মতো দেশে এরা যা ইচ্ছা করতে পারে। তুমি চলো।
স্যার, আমি যাব না। ওরা যা ইচ্ছা করুক।
হাসনা, অন্য সবকিছু বাদ দাও। তুমি পেশেন্টের দিকে তাকাও। সে তোমার ওপর নির্ভর করে আছে। আমার ওপর তোমার রাগটা বড়, না পেশেন্টের প্রতি তোমার দায়িত্ব বড়?
আমি শালগায়ে বের হয়ে এলাম। ক্লিনিকে তখন অবস্থার পরিবর্তন হয়েছে। ওয়েটিংরুমে তিনজন শুধু বসে আছেন। রুগিণীর কাছে দুজন— একজন রুগিণীর শাশুড়ি। তিনি আমাকে দেখেই শীতল গলায় বললেন, রাগের মাথায় কী বলেছি কিছু মনে রেখো না মা। রাগ উঠলে আমার মাথা ঠিক থাকে না।
আমি বললাম, আমি কিছু মনে রাখিনি।
বউমা তখন থেকে বলছিল, সে তোমাকে যেন কী বলতে চায়। তুমি ওর কথাটা শোনো। ও খুব ভয় পেয়েছে।
আমি মেয়েটির পাশে এসে দাঁড়ালাম।
মেয়েটি ক্ষীণ স্বরে বলল, আপনারা ঘর থেকে যান মা। আমি ওর সঙ্গে একা কথা বলব। আর কেউ যেন না থাকে।
ভদ্রমহিলা দুজন নিতান্ত অনিচ্ছার সঙ্গে ঘর ছেড়ে গেলেন। মেয়েটা বলল, ভাই তুমি দরজাটা বন্ধ করে দাও।
তার কি দরকার আছে? আছে। তুমি লক করো। তোমার সঙ্গে আমার খুব জরুরি কথা, দরজা বন্ধ করে তুমি আমার পাশে এসে বসো।
আমি তা-ই করলাম। কনট্রেশানের সময় কমে এসেছে। ব্যথার ধকল সামলাতে মেয়েটির খুবই কষ্ট হচ্ছে। তার গলার স্বর পালটে গেছে। মনে হচ্ছে সে অনেকদূর থেকে কথা বলছে। সে আমার হাত ধরে বলল, ভাই তোমার কি রাগ কমেছে?
হ্যাঁ কমেছে।
তুমি আমার গায়ে হাত দিয়ে বলো যে তোমার রাগ কমেছে।
আমি তার কপালে হাত রেখে বললাম, আমার রাগ কমেছে।
আমি তোমাকে তুমি তুমি করে বলছি বলে রাগ করছ না তো? তুমি নিশ্চয়ই বয়সে আমার বড়।
আমি মোটেই রাগ করিনি।
আমি সবাইকেই তুমি তুমি বলি না। যাদের আমার খুব প্রিয় মনে হয়, খুব আপন মনে হয় তাদের আমি তুমি বলি। তোমাকে প্রথম দেখেই আমার ভালো লেগেছে। তুমিও কিন্তু আমাকে তুমি বলবে।
কথা বলতে তোমার কষ্ট হচ্ছে, তুমি বরং চুপ করে থাকো। বড় বড় করে নিশ্বাস নাও। আমার মনে হয় তোমার প্লাসেন্টা ভাঙতে শুরু করেছে।
আর কত দেরি?
এখনও দেরি আছে। রাত তিনটার আগে কিছু হবে না। রাত তিনটা পর্যন্ত তোমাকে কষ্ট করতে হবে।
এখন কটা বাজে?
বারোটা একুশ।
মনে হচ্ছে ঘড়ি চলছেই না।
আমি উঠে দাঁড়ালাম। কিছু রুটিনকাজ আছে। এগুলি সারতে হবে। নরমাল ডেলিভারির জন্য বাচ্চার পজিশন ঠিক আছে। তবু ইমার্জেন্সির জন্যে তৈরি থাকা ভালো।
মেয়েটি বলল, যেজন্যে তোমাকে বসিয়েছিলাম তা এখনও বলিনি। তুমি বসো। উঠে দাঁড়ালে কেন? আসল কথা তো বলিনি।
আমি বসলাম।
মেয়েটি ফিসফিস করে বলল, ওরা আমার বাচ্চাটাকে মেরে ফেলবে।
আমি চমকে উঠলাম। এই মেয়ে এসব কী বলছে, প্রচণ্ড যন্ত্রণায় আবোল-তাবোল বকছে না তো?
আমি জানি ওরা আমার বাচ্চাটাকে মেরে ফেলবে।
কারা?
আমার শ্বশুরবাড়ির লোকরা। ডাক্তার, নার্স সবাইকে টাকা দিয়ে কিনে ফেলেছে। তোমাকেও কিনবে। তারপর বাচ্চাটাকে মারবে।
তুমি এসব কী বলছ?
যা সত্যি আমি তা-ই বলছি।
ওরা বাচ্চাকে মারবে কেন?