যা-ই হোক, বাড়ি থেকে বের হয়েও খুব একটা দূরে গেলাম না। একটা হোটেলে ঘর ভাড়া করে রইলাম। দেখি সেখানে কাজ করার খুব অসুবিধা সারাক্ষণ হইচই। কিছু-কিছু কামরায় রাতদুপুরে মদ খেয়ে মাতলামিও করে। মেয়েছেলে নিয়ে আসে।
হোটেল ছেড়ে দিয়ে শহরতলিতে একটা বেশ বড় বাড়ি ভাড়া করে বসলাম। এক জজসাহেব শখ করে বাড়ি বানিয়েছিলেন। তার শখ হয়তো এখনও আছে, ছেলেমেয়েদের শখ মিটে গেছে। এ-বাড়িতে কেউ আর থাকতে আসে না।
একজন কেয়ারটেকার-কাম মালী-কাম দারোয়ান আছে। বাড়ির পুরো দায়িত্ব তার। লোকটিকে দেখেই মনে হয় বদলোক। আমাকে যে বাড়িভাড়া দিয়েছে মনে হচ্ছে নিজ দায়িত্বেই দিয়েছে। ভাড়ার টাকা মালিকের কাছে পৌঁছাবে বলে মনে হলো না। ওটা নিয়ে আমার মাথাব্যথা নেই। পৌঁছলে পৌঁছবে, না পৌঁছলে নেই। আমার এক মাস থাকার কথা সেটা থাকতে পারলেই হলো। নিরিবিলি বাড়ি, আমার খুবই পছন্দ হলো। লেখালেখির জন্যে চমৎকার।
কেয়ারটেকারের নাম ইয়াকুব। বয়স পঁয়তাল্লিশের কাছে। রিপালসিভ ধরনের চেহারা, তবে গলার স্বরটা অতি মধুর। আমি একাই এ-বাড়িতে থাকব শুনে সে বিস্মিত গলায় বলল, স্যার কি সত্যি সত্যি একা থাকবেন?
হ্যাঁ।
বিষয়টা কী?
বিষয় কিছু না। পড়াশোনা করব। লেখালেখি করব।
আর খাওয়াদাওয়া? হোটেল এইখানে পাবেন কোথায়? সেই যদি শহরে যান। পাঁচ মাইলের ধাক্কা।
রান্না করে দেবে এমন কাউকে পাওয়া যায় না? টাকা-পয়সা দেব।
আপনি বললে আমি রাঁধব। খেতে পারবেন কি না সেটা হলো কথা।
পারব। খাওয়া নিয়ে আমার কোনো খুঁতখুঁতানি নেই।
আরেকটা জিনিস বলে রাখি স্যার। মুরগি ছাড়া কিন্তু কিছু পাওয়া যায় না। হাটবারে মাছটাছ পাওয়া যায়। হাটবারের দেরি আছে। আর চালটা স্যার একটু মোটা আছে। আপনার নিশ্চয়ই চিকন চাল খেয়ে অভ্যাস।
চিকন চাল খেয়ে অভ্যাস ঠিকই, মোটা চালে অসুবিধা হবে না। তবে ভাত যেন শক্ত না হয়। শক্ত ভাত খেতে পারি না।
দেখা গেল লোকটি রান্নায় দ্রৌপদী না হলেও তার কাছাকাছি। দুপুরে খুব ভালো খাওয়াল। রাতেও নতুন নতুন পদ করল। আমি বিস্মিত। রাতে খেতে খেতে বললাম, এত ভালো রান্না শিখলে কোথায়?
ইয়াকুব গম্ভীর মুখে বলল, আমার স্ত্রীর কাছে শিখেছি। খুব ভালো রাঁধতে পারত।
পারত বলছ কেন? এখন কি পারে না?
ইয়াকুব গম্ভীর হয়ে গেল। ভাবলাম নিশ্চয়ই খুব ব্যক্তিগত কোনো ব্যাপার। এখন আর প্রশ্নের জবাব পাওয়া যাবে না। তবে সহজেই নিজেকে সামলে নিল। সহজ স্বরে বলল, এখন পারে কি পারে না জানি না স্যার। আমার সঙ্গে থাকে না।
কোথায় থাকে?
জানি না কোথায় থাকে। ওর চরিত্র খারাপ ছিল। এর তার সাথে যোগাযোগ ছিল। বিশ্রী অবস্থা। বলার মতো না। অনেক দেনদরবার করেছি, কিছু লাভ হয় নাই। তারপর সাত বছরের দুই মেয়ে ঘরে রেখে পালিয়ে গেছে, বুঝে দেখেন কত বড় হারামি।
কতদিন আগের কথা?
বছর দুই।
কোনো খবর পাওয়া যায়নি?
মোড়লগঞ্জ বাজারে নাকি দেখা গিয়েছিল আমার কোনো আগ্রহ ছিল। খোঁজ নেই নাই।
এদের জীবনের এইজাতীয় কিচ্ছাকাহিনী শুনতে সাধারণত ভালোই লাগে। আমার লাগল না। আমাদের সবার জীবনেই একান্ত সমস্যা আছে। সেইসব নিয়ে মাথা ঘামালে চলে না। কিন্তু ইয়াকুব মনে হলো কথা বলবেই।
জীবনে বড় ভুল কী করেছিলাম জানেন স্যার? সুন্দরী বিয়ে করেছিলাম। ডানাকাটা পরী বিয়ে করেছিলাম।
বউ খুব সুন্দরী ছিল?
আগুনের মতো ছিল। আগুন থাকলেই পোকামাকড় আসে। তা-ই ভয় আর তা হল অন থাক হয়। আমার জীবন হলো অতিষ্ঠ। একদিন মোড়লগঞ্জের বাজারে গেছি, ফিরে এসে দেখি সদরদরজা বন্ধ। অনেকক্ষণ ধাক্কাধাক্কি করলাম, কেউ দরজা খোলে না। শেষে ধুপ করে জানালা দিয়ে লাফ দিয়ে কে যেন দৌড় দিল। আমি বউরে বললাম— এ কে? বউ বলল, আমি কী জানি কে?
ইয়াকুব একের পর এক বউয়ের কীর্তিকাহিনী বলতে লাগল, আমি একসময় বিরক্ত হয়ে বললাম
ঠিক আছে বাদ দাও এসব কথা।
বাদ দিতে চাইলেও বাদ দেয়া যায় না। তিনবার সালিশি বসল। সালিশিতে ঠিক হলো বউরে তালাক দিতে হবে। তালাক দিলাম না। মন মানল না। তার ওপর যমজ মেয়ে আছে। এর ফল হইল এই…
স্ত্রী কোথায় আছে তুমি জান না?
জী না।
কী নাম মেয়েদের?
যমজ মেয়ে হয়েছিল জনাব। তুহিন একজনের নাম, তুষার আরেকজনের নাম। নাম রেখেছিল মেয়ের মা।
ভালো, খুব ভালো।
কোনোকিছু দরকার লাগলে এদের বলবেন। মেয়েরা এইখানেই থাকে, ডাক দিলেই আসবে।
না, আমার কিছু লাগবে না।
বিরক্ত করলেও বলবেন। থাবড়া দিয়ে গাল ফাটায়ে দিব। মেয়েগুলি বেশি সুবিধার হয় নাই। মায়ের খাসলত পেয়েছে। সারাদিন সাজগোজ। এই পায়ে আলতা, এই ঠোটে লিপস্টিক।
স্কুলে পড়ে না?
আরে দূর–পড়াশোনা! এরা যায় আর আসে।
মেয়ে দুটিকে আমার অবিশ্যি খুবই পছন্দ হলো। দুজনই হাস্যমুখ। সারাক্ষণ হাসছে। সবসময় সেজেগুজে আছে। কাজেরও খুব উৎসাহ। যদি বলি, এই এক গ্লাস পানি দাও তো। অমনি ছুটে যাবে। দুজনই দুহাতে দুটা পানিভরতি গ্লাস নিয়ে এসে বলবে, চাচা আমারটা নেন। চাচা আমারটা নেন। আধ গ্লাস পানি খেলেই যেখানে চলত সেখানে বাধ্য হয়ে দুগ্লাস খাই যাতে মেয়ে দুটোর কোনোটাই কষ্ট না পায়।
স্নেহ নিমগামী। যত দিন যেতে লাগল বাচ্চা দুটিকে আমার ততই পছন্দ হতে লাগল। ছোটখাটো কিছু উপহার কিনে দিলাম। দুজনের জন্যে দুটা রং পেন্সিলের সেট, ছোট ছোট আয়না। যা-ই পায় আনন্দে লাফায়। বড় ভালো লাগে দেখতে। ঐ বাড়িতে দেখতে দেখতে এগারো দিন কেটে গেল। বারো দিনের দিন একটা ঘটনা ঘটল। ঘটনাটা বলার আগে পারিপার্শ্বিক অবস্থার একটা বর্ণনা দিয়ে নিই।