কীভাবে জবাব দেবে?
বোতামটা অক্ষরগুলির উপর যাবে। কোন কোন অক্ষরের উপর যাবে সেটা খেয়াল রাখতে হবে। ভূতটার নাম যদি হয় রহিম তা হলে প্রথমে যাবে আর-এর উপর, তারপর এ-এর উপর, তারপর এইচ— বুঝতে পারছিস?
বোতামটা আপনাআপনি যাবে?
না, আঙুল দিয়ে ছুঁয়ে রাখতে হবে।
ভাইয়া ভূত কি সত্যি সত্যি আসে?
আরে দূর দূর। ভূত আছে নাকি যে আসবে! আমেরিকানদের এটা হচ্ছে পয়সা বানানোর একটা ফন্দি। এত সহজে আত্মা চলে এলে তো কাজই হতো!
আলাউদ্দিন আমেরিকানদের স্বভাবচরিত্র সম্পর্কে মজার মজার গল্প করতে লাগল। আলাউদ্দিনের মা রাহেলার মনে ক্ষীণ আশা–গল্প যেভাবে জমেছে তাতে মনে হয় না ছেলে বউকে নিয়ে হোটেলে যাবে। যদি সত্যি সত্যি যায় তা হলে তিনি মানুষের কাছে মুখ দেখাতে পারবেন না। এমনিতেই বিদেশী বউয়ের কথায় অনেকেই হাসাহাসি করছে। জামশেদ সাহেবের স্ত্রী গত সপ্তাহে এসে সরু গলায় বললেন–বাঙালি ছেলেরা যে বিদেশে গিয়েই বিদেশিনী বিয়ে করে ফেলে ঐসব বিদেশিনীগুলি নিচু জাতের। ঝি, জমাদারনি এইসব। ভদ্রলোকের মেয়েরা বাঙালি বিয়ে করতে যাবে কেন? ওদের গরজটা কী?
রাহেলা ক্ষীণ গলায় বললেন, আপনাকে কে বলেছে?
বলবে আবার কে? এ তো সবাই জানে। বাঙালি ছেলেগুলির সাদা চামড়া দেখে আর হুশ থাকে না। ওরা তো প্রথম প্রথম জানে না যে ঐ দেশের ঝিয়ের চামড়াও সাদা, আবার মেথরানির চামড়াও সাদা।
রাহেলা এইসব কথার কোনো জবাব দিতে পারেননি। শুধু শুনে গেছেন। এখন যদি ছেলে বউ নিয়ে হোটেলে চলে যায় তা হলে কী হবে? সবাই তো গায়ে থুথু দেবে।
অবিশ্যি তিনি যথাসাধ্য চেষ্টা করেছেন ছেলে এবং ছেলের বউয়ের জন্যে একটা ঘর ভালোমতো সাজাতে। নাসরিনের ঘরটাই সাজাতে হয়েছে। দেয়ালে চুনকাম করা হয়েছে। টিউবলাইট লাগানো হয়েছে। একটা ফ্যান ঘরে আছে। সেই ফ্যান ঘটাং ঘটাং শব্দ হয় বলে নতুন একটা সিলিং ফ্যান কেনা হয়েছে। তারপরেও যদি ছেলে বউ নিয়ে হোটেলে ওঠে তিনি কী আর করবেন? তার আর কী করার আছে?
রাতের খাওয়া শেষ হবার সঙ্গে সঙ্গে আলাউদ্দিন বলল, আমরা তাহলে উঠি মা।
রাহেলা ক্ষীণ গলায় বললেন, কোথায় যাবি?
আলাউদ্দিন বিরক্ত গলায় বলল, কোথায় যাবি বলছ কেন মা? আগেভাগে তো বলেই রেখেছি একটা ভালো হোটেলে উঠতে হবে। ক্লারা গতরাতে এক ফোঁটাও ঘুমায়নি। বেচারি গরমে সেদ্ধ হয়ে গেছে। বাতাস নেই এক ফোঁটা।
ফ্যান তো আছে।
বাতাস গরম হয়ে গেলে ফ্যানে লাভ কী? তোমরা গরম দেশের মানুষ ওর কষ্টটা কী বুঝবে? আমি নিজেই সহ্য করতে পারছিলাম না, আর ও…
বউকে নিয়ে হোটেলে গিয়ে উঠলে লোকে নানান কথা বলবে।
আলাউদ্দিন এই কথায় রাগে জ্বলতে লাগল। হড়বড় করে এমন কথা বলতে লাগল যার তেমন কোনো অর্থ নেই।
তার বাবা মনসুর সাহেব যিনি কখনোই কিছু বলেন না তিনি শেষ পর্যন্ত বলে ফেললেন— তুই খামাকা চিৎকার করছিস কেন?
আমি খামাখা চিৎকার করছি? আমি খামাখা চিৎকার করছি? আমি শুধু বলছি লোকজনের কথা নিয়ে তোমরা নাচানাচি কর কেন? তোমরা যদি না খেয়ে মর লোকজন এসে তোমাদের খাওয়াবে? প্রতি মাসে দেড়শো ডলারের যে মানি অর্ডারটা পাও সেটা কি লোজন দেয়? বলো দেয় লোকজন?
মনসুর সাহেব দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে সিগারেট ধরিয়ে বললেন, যা যেখানে যেতে চাস। আলাউদ্দিন তিক্ত গলায় বলল, তোমরা যে ভাবছো ছেলে ঘর ছেড়ে হোটেলে চলে যাচ্ছে, কাজেই ছেলে পর হয়ে গেল–এটা ঠিক না।
আমরা কিছু ভাবছি না। তুই আর ভ্যাজভ্যাজ করিস না। মাথা ধরিয়ে দিয়েছিস।
মাথা ধরিয়ে দিয়েছি? আমি মাথা ধরিয়ে দিয়েছি?
আট বছর পর ফিরে আসা পুত্রের সঙ্গে দ্বিতীয় রাতেই বাড়ির সদস্যদের খণ্ড প্রলয়ের মতো হয়ে গেল। নাসরিন মনে-মনে বলল, বেশ হয়েছে। খুব মজা হয়েছে। আমি খুব খুশি হয়েছি।
ক্লারা ঝগড়ার ব্যাপারটা কিছুই বুঝল না। একবার শুধু ভ্রু কুঁচকে বলল, তোমরা এত চেঁচিয়ে কথা বলো কেনো? বলেই জবাবের অপেক্ষা না করে বসার ঘরে টিকটিকি দেখতে গেল। বাংলাদেশের এই ছোট্ট প্রাণী তার হৃদয় হরণ করেছে। সে টিকটিকির একুশটা ছবি এ পর্যন্ত তুলেছে। ম্যাকরো লেন্স আনা হয়নি বলে খুব আফসোসও করছে। ম্যাকরো লেন্সটা থাকলে ক্লোজআপ নেয়া যেত।
খুব সঙ্গত কারণেই গভীর রাত পর্যন্ত এ পরিবারের কোনো সদস্য ঘুমুতে পারল না। বারান্দায় বসে রাহেলা ক্রমাগত অবর্ষণ করতে লাগলেন। একসময় মনসুর সাহেব বললেন, আর কেঁদো না, চোখে ঘা হয়ে যাবে। তোমার ছেলের আশা ছেড়ে দাও। বিদেশী পেতনি বিয়ে করে ধরাকে সরা দেখছে। হারামজাদা।
নাসরিন আজ ওর ঘরে ঘুমুতে পারছে।
ঘরে ঢুকে তার মনটা খারাপ হয়ে গেল। কত আগ্রহ করে তারা সবাই মিলে ঘর সাজিয়ে দিয়েছে তবু ভাইয়ার পছন্দ হলো না। এই ঘরটা কি হোটেলের চেয়ে কম সুন্দর হয়েছে! মাথার পাশে টেবিল-ল্যাম্প। পায়ের দিকের দেয়ালে সূর্যাস্তের ছবি। খাটের পাশে মেরুন রঙের বেডসাইড কার্পেট। জানালা খুলে ফুল স্পিডে ফ্যান ছেড়ে দিলে খুব একটা গরম কি লাগে? কই, তার তো লাগছে না! তার তো উলটো কেমন শীত-শীত লাগছে।
সে টেবিল-ল্যাম্প জ্বালাল। এত বড় খাটে একা ঘুমুতে কেমন যেন অস্বস্তি লাগছে। ভাইয়া থাকবে না জানলে বড় আপাকে জোর করে রেখে দিত। নাসরিন দীর্ঘনিশ্বাস ফেলল। আজ রাতটা তাদের জন্যে খুব খারাপ রাত। আজ রাতে তাদের কারোরই ঘুম হবে না। একা একা জেগে থাকা খুব কষ্টের।