বীণা সেই দৃশ্য দেখতে চায় না। সে কিছুতেই উপরের দিকে তাকাবে। সে জানে উপরের দিকে তাকালেই ভয়ংকর কিছু দেখবে। এমন ভয়ংকর কিছু যা ব্যাখ্যার অতীত, অভিজ্ঞতার অতীত।
কে যেন একজন খোলা ছাদে বসে আছে। রক্ত পড়ছে তার পা থেকে। ভারী, জেড়িত স্বরে ডাকল— বীণা, ও বীণা। শব্দ উপর থেকে আসছে। কেউ একজন বসে আছে গোসলখানার দেয়ালে। যে বসে আছে তাকে বীণা চেনে। না-দেখেও বীণা বলতে পারছে কে বসে আছে।
ও বীণা। বীণা।
বীণা তাকাল। হ্যাঁ, ঐ লোকটিই বসে আছে। তবে লোকটির মুখ পশুর মতো নয়। মায়ামাখা একটি মুখ। বড় বড় চোখ দুটি বিষগ্ন ও কালো। লোকটি পা ঝুলিয়ে বসে আছে। পা দুটি অস্বাভাবিক–থ্যাঁতলানো। চাপচাপ রক্ত সেই থ্যাঁতলানো পা বেয়ে চৌবাচ্চার জলে পড়ছে। লোকটি ভারী শ্লেম্মাজড়িত স্বরে ডাকল–বীণা, ও বীণা।
বীণা জ্ঞান হারাল।
তার জ্ঞান ফিরল তৃতীয় দিনে জামালপুর সদর হাসপাতালে। চোখ মেলে দেখল আরো অনেকের সঙ্গে বিছানার পাশে ইদরিস সাহেব বসে আছেন। তাঁকে টেলিগ্রাম করে আনানো হয়েছে। ইদরিস সাহেব গভীর মমতার সঙ্গে বললেন, কী হয়েছে রে মা?
বীণা ফোঁপাতে ফোঁপাতে বলল, ভয় পেয়েছি মামা।
ইদরিস সাহেব বিরক্ত গলায় বললেন, ভয় পাবারই কথা। ঐ জংলা বাড়িতে আমি নিজেই ভয় পাই আর তুই পাবি না? এখানে থাকার দরকার নেই, চল আমার সঙ্গে ঢাকায়। ঢাকায় গিয়ে আবার কলেজে যাওয়া-আসা শুরু কর। ঐ ছেলে আর তোকে বিরক্ত করবে না। বেচারা ট্রাক অ্যাকসিডেন্টে মারা গেছে।
বীণা চোখ বন্ধ করে ফেলল।
ইদরিস সাহেব নিজের মনেই বললেন, পায়ের উপর দিয়ে ট্রাক চলে গেছিল। দুটা পা-ই ছাতু হয়ে গেছে। হাসপাতালে নেয়ার আঠারো ঘণ্টা পরে মারা গেছে। খবর পেয়ে দেখতে গিয়েছিলাম। না গেলে অভদ্রতা হয়।
ইদরিস সাহেব খানিকক্ষণ চুপ থেকে বললেন, ছেলেটা খারাপ ছিল না, বুঝলি। খামোখাই আজেবাজে সন্দেহ করেছি। অতি দ্র ছেলে। তোর কথা জিজ্ঞেস করল। বেশ কয়েকবার জিজ্ঞেস করল।
বীণার ইচ্ছা করল বলতে আমার কথা কি জিজ্ঞেস করল মামা? সে বলতে পারল না।
ইদরিস সাহেব বললেন, ছেলেটার অ্যাকসিডেন্টের খবর তার অঞ্চলে পৌঁছামাত্র সেখানের সব লোক এসে উপস্থিত। হাজার হাজার মানুষ। হাউমাউ করে কাঁদছে। দেখবার মতো একটা দৃশ্য! বুঝলি বীণা, আমরা মানুষের বাইরেরটাই শুধু দেখি। অন্তর দেখি না। এটা খুবই আফসোসের ব্যাপার। তোর যাতে ভালো বিয়ে হয় এইজন্যে আমাকে কিছু টাকাও দিয়ে গেছে। না করতে পারলাম না। একটা মানুষ মারা যাচ্ছে কী করে না বলি! ঠিক না?
বেয়ারিং চিঠি
জমির সাহেব অফিস থেকে ফেরামাত্রই তাঁর বড় মেয়ে মিতু বলল, বাবা আজ তোমার একটা চিঠি এসেছে। বলেই সে মুখের হাসি গোপন করার জন্যে অন্যদিকে তাকাল।
মিতুর বয়স একুশ। এই বয়সের মেয়েদের মুখে অকারণে হাসি আসে। হাসি তামাশা জমির সাহেবের একেবারেই পছন্দ নয়, বিশেষ করে মা-বাবাকে নিয়ে হাসাহাসি। আজকাল অনেক পরিবারেই তিনি এই ব্যাপার দেখেন। মেয়ে বাবার সঙ্গে বসে আড্ডা দিচ্ছে খিলখিল করে হাসছে। এসব কী? তিনি একবার তার এক বন্ধুর বাড়িতে গিয়েছিলেন। সেই বন্ধুর মেয়ে বাবাকে নিয়ে খুব হাসি তামাশা করতে লাগল। এক পর্যায়ে বলে ফেলল, বাবা দিন-দিন তোমার চেহারা সুন্দর হচ্ছে। রাস্তায় বের হলে নিশ্চয়ই মেয়েরা তোমার দিকে তাকায়। জমির সাহেব স্তম্ভিত হয়ে গেলেন। তাঁর নিজের মেয়ে হলে চড় দিয়ে মেঝেতে ফেলে দিতেন। অন্যের মেয়ে বলে কিছু বলা গেল না। তবে ঐ বন্ধুর বাড়িতে যাওয়া তিনি ছেড়ে দিলেন।
মিতু চিঠিটি বাবার দিকে বাড়িয়ে দিতে দিতে বলল, বেয়ারিং চিঠি বাবা। দুটাকা দিয়ে চিঠি রাখতে হয়েছে। বলে আবার ফিক করে হেসে ফেলল।
জমির সাহেব কঠিন গলায় বললেন, হাসছিস কেন? বেয়ারিং চিঠি এসেছে এর মধ্যে হাসির কী হলো? এরকম ফাজলামি শিখছিস কোথায়?
মিতু মুখ কালো করে চলে গেল। বাবাকে সে সঙ্গত কারণেই অসম্ভব ভয় পায়। জমির সাহেব লক্ষ করলেন খামের মুখ খোলা। এরা চিঠি পড়েছে। এই বেআদবিও সহ্য করা মুশকিল। একজনের চিঠি অন্যজন পড়বে কেন? খামে তাঁর নাম লেখা দেখার পরেও এরা কোন সাহসে চিঠি খোলে? রাগে জমির সাহেবের গা কাপতে লাগল। এই অবস্থায় তিনি চিঠি পড়লেন। একবার, দুবার, তিনবার। তার মাথা ঘুরতে লাগল। সুস্মিতা নামের এক মেয়ের চিঠি। তাঁর কাছে লেখা। সম্বোধন হচ্ছে প্রিয়তমেষু। এর মানে কী? সুস্মিতা কে? সুস্মিতা নামের কাউকেই তিনি চেনেন বলে মনে করতে পারলেন না। কলেজে পড়ার সময় কমলা নামের এক মেয়ের প্রতি খুব দুর্বলতা অনুভব করেছিলেন। মেয়েটির বিয়ে হয়ে যাবার পর দুর্বলতা কেটে যায়। এ ছাড়া অন্য কোনো মেয়েকে তিনি চেনেন না। জমির সাহেব কপালের ঘাম মুছে চতুর্থবারের মতো চিঠিটি পড়লেন।
প্রিয়তমেষু,
তুমি কেমন আছ? তোমার কথা খুব মনে হয়। তোমার শরীর এত খারাপ হয়েছে কেন? শরীরের আরো যত্ন নেবে। আমি দেখেছি তুমি বাসে যাওয়া-আসা কর। তোমাকে অনুরোধ করছি সপ্তাহখানেক বাসে উঠবে না। কাল তোমাকে নিয়ে একটা দুঃস্বপ্ন দেখেছি। দুঃস্বপ্নটা হচ্ছে তুমি বাসে উঠতে গিয়ে পিছলে পড়ে পা ভেঙে ফেলেছ। স্বপ্নকে গুরুত্ব দেয়ার কোনো মানে হয় না। তবু অনুরোধ করছি এক সপ্তাহ বাসে উঠবে না।
বিনীতা
তোমার সুস্মিতা।