খুব সাবধানে জাভেদকে ডিঙিয়ে প্রিয়াংকা বিছানা থেকে নামে। তার হাত-পা কাঁপছে, তৃষ্ণায় বুক ফেটে যাচ্ছে, কানের কাছে কেমন ঝাঁ ঝাঁ শব্দ হচ্ছে। সব অগ্রাহ্য করে বারান্দায় চলে এল। আর তার সঙ্গে সঙ্গে বারান্দায় দাঁড়ানো মানুষটা বলল, প্রিয়াংকা এক গ্লাস পানি দাও তো!
বিছানায় যে-মানুষটা শুয়ে আছে এই মানুষটাই সেই জাভেদ। তার পরনে জাভেদের মতোই লুঙ্গি, হাতকাটা গেঞ্জি। মুখ গম্ভীর ও বিষণ্ণ।
প্রিয়াংকা ছুটে শোবার ঘরে চলে এল। কোনোমতে বিছানায় উঠল ঐ তো জাভেদ ঘুমুচ্ছে। গায়ে চাদর টানা–এতক্ষণ যা দেখেছি ভুল দেখেছি। যা শুনেছি তাও ভুল। কিছু-একটা আমার হয়েছে। ভয়ংকর কোনো অসুখ। সকাল হলে আমার এই অসুখ থাকবে না। আল্লাহ্ তুমি সকাল করে দাও। খুব তাড়াতাড়ি সকাল করে দাও। সব মানুষ জেগে উঠুক। সূর্যের আলোয় চারদিক ভরে যাক। সে জাভেদকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরল। জাভেদ ঘুম-ঘুম গলায় বলল, কী হয়েছে?
সকালবেলা সত্যি সব স্বাভাবিক হয়ে গেল। রাতে এরকম ভয় পাওয়ার জন্যে লজ্জা লাগতে লাগল। জাভেদ কলেজে চলে যাবার পর সে স্বাভাবিক ভঙ্গিতে মরিয়মকে তরকারি কাটায় সাহায্য করতে গেল। মরিয়ম বলল, আফার শইল কি খারাপ?
না।
আফনের কিছু করন লাগত না আফা। আফনে গিয়ে হুইয়া থাকেন।
এইমাত্র তো ঘুম থেকে উঠলাম, এখন আবার কী শুয়ে থাকব?
চা বানায় দেই?
দাও। আচ্ছা মরিয়ম, তোমার আগের আপাও কি আমার মতো চা খেত?
হ। তয় আফনের মতো চুপচাপ থাকত না। সারাদিন হইচই করত। গান-বাজনা করত।
মারা গেলেন কীভাবে?
হঠাৎ মাথা খারাপ হইয়া গেল। উল্টাপাল্টা কথা কওয়া শুরু করল—কী জানি দেখে।
প্রিয়াংকা শঙ্কিত গলায় বলল, কী দেখে?
দুইটা মানুষ নাকি দেখে। একটা আসল একটা নকল। কোনটা আসল কোনটা নকল বুঝতে পারে না।
তুমি কী বলছ তাও তো আমি বুঝতে পারছি না!
পাগল মাইনষের কথার কি ঠিক আছে আফা? নেন চা নেন।
প্রিয়াংকা মাথা নিচু করে চায়ের কাপে ছোট ছোট চুমুক দিচ্ছে। একবারও মরিয়মের দিকে চোখ তুলে তাকাচ্ছে না। তার ধারণা, তাকালেই মরিয়ম অনেক কিছু বুঝে ফেলবে। বুঝে ফেলবে যে প্রিয়াংকারও একই অসুখ হয়েছে। সে চায় না মরিয়ম কিছু বুঝুক। কারণ তার কিছুই হয়নি। অসুখ করেছে। অসুখ কি মানুষের করে না? করে। আবার সেরেও যায়। তারটাও সারবে।
রাত গভীর হচ্ছে। বাইরে বৃষ্টি পড়ছে টুপ টুপ করে। খোলা জানালায় হাওয়া আসছে। প্রিয়াংকা জাভেদকে জড়িয়ে ধরে শুয়ে আছে। তার চোখে
ঘুম নেই।
পাশের ঘরে বইয়ের পাতা ওলটানোর শব্দ হচ্ছে। এই যে সিগারেট ধরাল। সিগারেটের ধোঁয়ার গন্ধ ভেসে আসছে। ইজিচেয়ার থেকে উঠল ক্যাচ ক্যাচ শব্দ হচ্ছে ইজিচেয়ারে।
প্রিয়াংকা স্বামীকে সজোরে জড়িয়ে ধরে কাঁপা গলায় ডাকল, এই-এই।
ঘুম ভেঙে জাভেদ বলল, কী?
প্রিয়াংকা ফিসফিস করে বলল, কিছু না। তুমি ঘুমাও।
বীণার অসুখ
বীণার বয়স একুশ।
সে লালমাটিয়া কলেজে বি.এ. সেকেণ্ড ইয়ারে পড়ত। বীণার মামা ইদরিস সাহেব একদিন হঠাৎ বললেন, বীণা তোর কলেজে যাবার দরকার নেই। বাসায় থেকে পড়াশোনা কর। পরীক্ষার সময় পরীক্ষা দিলেই হবে। কলেজে আজকাল কী পড়াশোনা হয় তা তো জানাই আছে। যাওয়া নাযাওয়া একই।
বীণা ঘাড় নেড়ে ক্ষীণস্বরে বলল, জী আচ্ছা।
মামার কথার ওপর কথা বলার সাহস বীণার নেই। তার পড়াশোনার যাবতীয় খরচ মামা দেন। গত বছর গলার একটা চেন বানিয়ে দিয়েছেন। তা ছাড়া তার বিয়ের কথা হচ্ছে। বিয়ে যদি ঠিক হয় সেই খরচও মামাকেই দিতে হবে। বীণার বাবা প্যারালাইসিস হয়ে দেশের বাড়িতে পড়ে আছেন। তাঁর পক্ষে একটা টাকাও খরচ করা সম্ভব না। তিনি সবার কাছ থেকে টাকা নেন। কাউকে কিছু দেননি।
ইদরিস সাহেব বললেন, বীণা তুই আমাকে এক গ্লাস শরবত বানিয়ে দে। আর শোন, কলেজে না যাওয়া নিয়ে মন-টন খারাপ করিস না। মনখারাপের কিছু নেই।
জী আচ্ছা মামা।
বীণা শরবত আনতে চলে গেল। তার মনটা অসম্ভব খারাপ। কলেজ বন্ধ করে দেবার কোনো কারণ সে বুঝতে পারছে না। জিজ্ঞেস করার সাহসও নেই। দিনের পর দিন ঘরে বসে থেকেই-বা সে কী করবে? শরবত বানাতে বানাতে তার মনে হল— হয়তো তার বিয়ে ঠিকঠাক হয়ে গেছে। গফরগাঁয়ের ঐ ছেলে শেষ পর্যন্ত হয়তো রাজি হয়েছে। ওরাই হয়তো বলেছে— মেয়েকে কলেজে পাঠাবেন না। বিয়ে ঠিকঠাক হলে ছেলেপক্ষের লোকজন অদ্ভুত অদ্ভুত শর্ত দিয়ে দেয়।
গফরগাঁয়ের ঐ ছেলেটাকে একেবারেই পছন্দ হয়নি। কেমন যেন পশুপশু চেহারা। সোফায় বসেছিল দুই হাঁটুতে দুহাত রেখে। মুখ একটু হাঁ হয়েছিল। সেই হাঁ-করা মুখের ভেতর কালো কুচকুচে জিভ। বীণার দিকে এক পলক তাকাতেই বীণার বুক ধক করে উঠল। মনে হলো একটা পশু জিভ বের করে বসে আছে। তার নাকে ঝাঁঝালো গন্ধও এসে লাগল। গন্ধ ঐ লোকটার থেকে আসছিল। টক দুধ এবং পোড়া কাঠের গন্ধ একত্রে মেশালে যেরকম গন্ধ হয় সেরকম একটা গন্ধ। গা কেমন ঝিমঝিম করে।
লোকটা তাকে কোনো প্রশ্ন করল না। শুধু পলকহীন চোখে তাকিয়ে রইল। বীণার একবার মনে হলো, লোকটার চোখে হয়তো পাতা নেই। সাপের যেমন চোখের পাতা থাকে না সেরকম। লোকটার সঙ্গে বয়স্ক যে দুজন মানুষ এসেছিলেন তারা অনবরত কথা বলতে লাগলেন। একজন বীণাকে ডাকতে লাগলেন আন্টি। চুল-দাড়ি পাকা বয়স্ক একজন লোক যদি আন্টি ডাকে তখন ভয়ংকর রাগ লাগে। কোনো কথারই জবাব দিতে ইচ্ছা করে না। বীণা অবিশ্যি সব প্রশ্নের জবাব দিল কারণ মামা তার পাশেই বসে আছেন। মামা বসেছেন সোফার ডানদিকে— সে বাঁদিকে।