ফজরের আজানের পর প্রিয়াংকার চোখ ঘুমে জড়িয়ে এল। ঘুম ভাঙল বেলা সাড়ে নটায়। ঘরের ভেতর রোদ ঝলমল করছে। জাভেদ চলে গেছে কলেজে। মরিয়ম জিতু মিয়ার সঙ্গে তারস্বরে ঝগড়া করছে। প্রিয়াংকার সব ভয় কপূরের মতো উবে গেল। রাতে সে যে অসম্ভব ভয় পেয়েছিল এটা ভেবে এখন নিজেরই কেমন হাসি পাচ্ছে। সে স্বপ্ন দেখেছিল। স্বপ্ন ছাড়া আর কিছুই না। মানুষ কতরকম দুঃস্বপ্ন দেখে। এও একটা দুঃস্বপ্ন। এর বেশি কিছু না। মানুষ তো এর চেয়েও ভয়াবহ দুঃস্বপ্ন দেখে। সে নিজেই কতবার দেখেছে। একবার স্বপ্নে দেখেছিল সম্পূর্ণ নগ্নগায়ে বাসে করে কোথায় যেন যাচ্ছে। ছি ছি, কী ভয়ংকর স্বপ্ন!
প্রিয়াংকা বিছানা থেকে নামতে নামতে ডাকল, মরিয়ম!
জে আম্মা।
ঝগড়া করছ কেন মরিয়ম?
জিতু কাচের জগটা ভাইঙ্গা ফেলছে আম্মা।
চিৎকার করলে তো জগ ঠিক হবে না। চিৎকার করবে না।
জিনিসের উপর কোনো মায়া নাই… মহব্বত নাই…
ঠিক আছে তুমি চুপ করো। তোমার স্যার কি চলে গেছেন?
জে।
কখন আসবেন কিছু বলে গেছেন?
দুপুরে খাইতে আসবেন।
আচ্ছা যাও, তুমি আমার জন্যে খুব ভালো করে এক কাপ চা বানিয়ে আনো।
নাশতা খাইবেন না আম্মা?
না। তোমার স্যার নাশতা করেছে?
জে।
মরিয়ম চা আনতে গেল। প্রিয়াংকা মুখ ধুয়ে চায়ের কাপ নিয়ে বসল। এখন তার করার কিছুই নেই। দুজন মানুষের সংসার। কাজ তেমন কিছু থাকে না। এ সংসারে কাজকর্ম যা আছে সবই মরিয়ম দেখে এবং খুব ভালোমতোই দেখে। চুপচাপ বসে থাকা ছাড়া প্রিয়াংকার কোনো কাজ নেই। এই ফ্ল্যাটে অনেক গল্পের বই আছে। গল্পের বই পড়তে প্রিয়াংকার ভালো লাগে না। ইউনিভার্সিটির ভর্তি পরীক্ষার জন্যে পড়াশোনা করা দরকার। পড়তে ভালো লাগে না। কারণ প্রিয়াংকা জানে পড়ে লাভ হবে না। সে পাস করতে পারবে না। কোনো একটা কলেজেই তাকে বিএ পড়তে হবে। কে জানে হয়তো জাভেদের কলেজেই। যদি তা-ই হয় তা হলে জাভেদ কি তাকে পড়াবে? ক্লাসে তাকে কী ডাকবে— স্যার?
চায়ের কাপ নিয়ে বারান্দায় এসে দাঁড়াতেই মরিয়ম তাকে একটা চিঠি দিল।
কিসের চিঠি মরিয়ম?
স্যার দিয়ে গেছে।
চিঠি না–চিরকুট। জাভেদ লিখেছে— প্রিয়াংকা, তোমার গা-টা গরম মনে হলো। তৈরি হয়ে থেকো, আমি দুপুরে তোমাকে একজন ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাব।
প্রিয়াংকার মনটা হঠাৎ ভালো হয়ে গেল। মানুষটা ভালো। হৃদয়বান এবং বুদ্ধিমান। স্বামীদের কতরকম অন্যায় দাবি থাকে তার তেমন কিছু নেই। অন্যদের দিকেও খুব তীক্ষ্ণ দৃষ্টি। প্রিয়াংকা কেন, আজ যদি জিতু মিয়ার জ্বর হয় তাকেও সঙ্গে সঙ্গে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাবে। জাভেদ এমন একজন স্বামী যার ওপর ভরসা করা যায়।
যে যা-ই বলুক, এই মানুষটাকে স্বামী হিসেবে পেয়ে তার খুব লাভ হয়েছে। জাভেদের আগে একবার বিয়ে হয়েছে সেটা নিশ্চয়ই অপরাধ নয়। বেচারার স্ত্রী মারা গেছে বিয়ের আটমাসের মাথায়। স্ত্রীর মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে সে বিয়ে করার জন্যেও অস্থির হয়ে পড়েনি। দুবছর অপেক্ষা করেছে। মামা মামি যে তাকে দোজবর একটি ছেলের সঙ্গে বিয়ে দিয়েছেন এই নিয়েও প্রিয়াংকার মনে কোনো ক্ষোভ নেই। মামা দরিদ্র মানুষ। তিনি আর কত করবেন! যথেষ্টই তো করেছেন। মামি নিজের গয়না ভেঙে তাকে গয়না করে দিয়েছেন। কজন মানুষ এরকম করে? আট-নটা নতুন শাড়ি কিনে দিয়েছেন। এর মধ্যে একটা শাড়ি আছে বারোশো টাকা দামের।
জাভেদের আগের স্ত্রীর অনেক শাড়ি এই ঘরে রয়ে গেছে। ঐ মেয়েটির শাড়ির দিকে তাকালেই মনে হয় খুব শৌখিন মেয়ে ছিল। ড্রেসিংটেবিল ভরতি সাজগোজের জিনিস। কিছুই ফেলে দেয়া হয়নি। বসার ঘরে মেয়েটির বড় একটি বাঁধানো ছবি আছে। খুব সুন্দর মুখ। তাকিয়ে থাকতে ইচ্ছা করে।
এই ডাক্তার জাভেদের বন্ধু।
কাজেই ডাক্তার অনেক আজেবাজে রসিকতা করল— যেমন হাসিমুখে বলল ভাবিকে এমন শুকনো দেখাচ্ছে কেন? সংসারে নতুন কেউ আসছে নাকি? হা-হা-হা। বুদ্ধিমান হয়ে ঠিক কাজটি করে ফেলেননি তো?
দু-সপ্তাহও হয়নি যার বিয়ে হয়েছে তার সঙ্গে কি এরকম রসিকতা করা যায়? রাগে প্রিয়াংকার গা জ্বলতে লাগল।
ডাক্তার তাকে একগাদা ভিটামিন দিলেন এবং বললেন, ভাবিকে মনে হচ্ছে রাতে ঘুমুতে-টুমুতে দেয় না। দুপুরে ঘুমিয়ে পুষিয়ে নেবেন, নয়তো শরীর খারাপ করবে—হা-হা-হা।
প্রিয়াংকা বাড়ি ফিরল রাগ করে। সন্ধ্যা মেলাবার পর সেই রাগ ভয়ে রূপান্তরিত হলো। সীমাহীন ভয় তাকে গ্রাস করে ফেলল। এ-ঘর থেকে ওঘরে যেতে ভয়। বারান্দায় যেতে ভয়। হাতমুখ ধুতে বাথরুমে গিয়েছেবাথরুমের দরজা বন্ধ করার সঙ্গে সঙ্গে মনে হলো আর সে দরজা খুলতে পারবে না। দরজা আপনাআপনি আটকে গেছে। সে দরজা খোলার চেষ্টা না করেই কাঁপা গলায় ডাকতে লাগল—মরিয়ম, ও মরিয়ম! মরিয়ম!
রাতে আবার ঐদিনের মতো হলো। জাভেদ পাশেই প্রায় নিশ্চিন্তে ঘুমুচ্ছে আর প্রিয়াংকা স্পষ্টই শুনছে স্যান্ডেল পরে বারান্দায় কে যেন পায়চারি করছে। প্রিয়াংকা নিজেকে বোঝাল ও কেউ না, ও হচ্ছে মরিয়ম। মরিয়ম হাঁটছে। ছোট ছোট পা ফেলছে। মরিয়ম ছাড়া আর কে হবে? নিশ্চয়ই মরিয়ম। স্যান্ডেলে কেমন ফটফট শব্দ হচ্ছে। জাভেদ যখন স্যান্ডেল পরে হাঁটে তখন এরকম শব্দ হয় না। একবার কি বারান্দায় উঁকি দিয়ে দেখবে? কী হবে উঁকি দিলে? কিছুই হবে না। ভয়টা কেটে যাবে। রাত একটা বাজে–এমন কিছু রাত হয়নি। রাত একটায় ঢাকা শহরের অনেক দোকানপাট খোলা থাকে। এই তো পাশের ফ্ল্যাটের বাচ্চাটা কাঁদছে। এখন নিশ্চয়ই বারান্দায় যাওয়া যায়।