তোর কি বর পছন্দ হয়েছে?
হ্যাঁ।
সে কি তোকে ভয়-টয় দেখায়?
কী যে তুমি বল মামি, আমাকে ভয় দেখাবে কেন?
রাতে কি তোরা একসঙ্গে ঘুমাস?
প্রিয়াংকা লজ্জায় বেগুনি হয়ে গিয়ে বলল, হ্যাঁ।
সে কি তোকে অনেক রাত পর্যন্ত জাগিয়ে রাখে?
কীসব প্রশ্ন তুমি কর মামি!
আমি যা বলছি তার জবাব দে।
না, জাগিয়ে রাখে না।
মামি অনেকক্ষণ থাকলেন। প্রিয়াংকাদের ফ্ল্যাটে ঘুরে ঘুরে দেখলেন। কাজের মেয়ে এবং কাজের ছেলেটির সঙ্গে কথা বললেন। কাজের মেয়েটির নাম মরিয়ম। দেশ খুলনা। ঘরের যাবতীয় কাজ সে-ই করে। কাজের ছেলেটির নাম জিতু মিয়া। তার বয়স নয়-দশ। এদের দুজনের কাছ থেকেও খবর বার করার চেষ্টা করা হলো।
আচ্ছা মরিয়ম, তুমি কি ভয়-টয় পাও?
না। ভয় পামু ক্যা?
রাতে কিছু দেখ-টেখ না?
কী দেখমু?
আচ্ছা ঠিক আছে— যাও।
প্রিয়াংকার মামি কোনো রহস্য ভেদ করতে পারলেন না। তাঁর খুব ইচ্ছা ছিল জাভেদের সঙ্গে পুরো ব্যাপারটা নিয়ে আলাপ করবেন, পরামর্শ করবেন। প্রিয়াংকার জন্যে পারা গেল না। সে কাঁদো কাঁদো গলায় বলল, মামি তুমি যদি তাকে কিছু বল তাহলে আমি কিন্তু বিষ খাব। আল্লাহর কসম বিষ খাব। নয়তো ছাদ থেকে নিচে লাফিয়ে পড়ব।
তিনি কিছু জিজ্ঞেস করলেন না কারণ প্রিয়াংকা সত্যি বিষ-টিষ খেয়ে ফেলতে পারে। আমার মৃত্যুর জন্যে কেউ দায়ী নয় এই কথা লিখে একবার সে এক বোতল ডেটল খেয়ে ফেলেছিল। অনেক ডাক্তার হাসপাতাল করতে হয়েছে। এই কাণ্ড সে করেছিল অতি তুচ্ছ কারণে। তার এক বান্ধবীর সঙ্গে ঝগড়া করে। এই মেয়ের পক্ষে সবই সম্ভব। তাকে কিছুতেই ঘটানো উচিত নয়।
জাভেদ এল রাত সাড়ে আটটার দিকে। জাভেদের সঙ্গে খানিকক্ষণ টুকটাক গল্প করে প্রিয়াংকার মামি ফিরে গেলেন। তাঁর মনের মেঘ কাটল না। হলো কী প্রিয়াংকার? সে কী দেখে?
প্রিয়াংকা নিজে জানে না তার কী হয়েছে। মামি চলে যাবার পর তার বুক ধকধক করা শুরু হয়েছে। অল্প অল্প ঘাম হচ্ছে। অসম্ভব গরম লাগছে। কিছুক্ষণ পরপর মনে হচ্ছে বোধহয় নিশ্বাস বন্ধ হয়ে যাচ্ছে।
তারা খাওয়াদাওয়া করে রাত সাড়ে দশটার দিকে ঘুমুতে গেল। জাভেদ বিছানায় শোয়ামাত্র ঘুমিয়ে পড়ে। আজ তা-ই হলো। জাভেদ ঘুমুচ্ছে। তালে তালে বিশ্বাস পড়ছে। জেগে আছে প্রিয়াংকা। কিছুক্ষণের মধ্যেই তার পানির পিপাসা পেল। প্রচণ্ড পানির পিপাসা। পানি খাবার জন্যে বিছানা ছেড়ে নামতে হবে। যেতে হবে পাশের ঘরে কিন্তু তা সে করবে না। অসম্ভব। কিছুতেই না। পানির তৃষ্ণায় মরে গেলেও না। এই পানি খেতে গিয়েই প্রথমবার তার অসুখ ধরা পড়েছিল। ভয়ে ঐদিনই সে মরে যেত। কেন মরল না? মরে গেলেই ভালো হতো। তার মতো ভীতু মেয়ের মরে যাওয়াই উচিত।
ঐ রাতে সে বেশ আরাম করে ঘুমাচ্ছিল। হঠাৎ বৃষ্টি হবার কারণে চারদিক বেশ ঠাণ্ডা। জানালা দিয়ে ফুরফুরে বাতাস আসছে। ঘুমুবার জন্যে চমকার রাত। একঘুমে সে কখনো রাত পার করতে পারে না। মাঝখানে একবার তাকে উঠে পানি খেতে হয় কিংবা বাথরুমে যেতে হয়। সেই রাতেও পানি খাবার জন্যে উঠল। জাভেদ কাত হয়ে ঘুমুচ্ছে। গায়ে পাতলা চাদর দিয়ে রেখেছে। অদ্ভুত অভ্যাস মানুষটার, যত গরমই পড়ক গায়ে চাদর দিয়ে রাখবে। প্রিয়াংকা খুব সাবধানে গায়ের চাদর সরিয়ে দিল। আহা আরাম করে ঘুমুক। কেমন ঘেমে গেছে।
স্বামীকে ডিঙিয়ে বিছানা থেকে নামল। স্বামীকে ডিঙিয়ে ওঠানামা করা ঠিক হচ্ছে না— হয়তো পাপ হচ্ছে। কিন্তু উপায় কী, প্রিয়াংকা ঘুমোয় দেয়ালের দিকে। খাট থেকে নামতে হলে স্বামীকে ডিঙাতেই হবে।
তাদের শোবার ঘর অন্ধকার, তবে পাশের ঘরে বাতি জ্বলছে। এই একটা বাতি সারারাতই জ্বলে, ঘরটা জাভেদের লাইব্রেরি ঘর। এই ঘরেই জাভেদ পরীক্ষার খাতা দেখে, পড়াশোনা করে। ঘরে আসবাবপত্র তেমন কিছু নেই। একটা বুকশেলফে কিছু বই, পুরনো ম্যাগাজিন। একটা বড় টেবিল। টেবিলের উপর রাজ্যের পরীক্ষার খাতা। একটা ইজিচেয়ার। ইজিচেয়ারের পাশে সাইড টেবিলে টেবিল-ল্যাম্প।
দরজার ফাঁক দিয়ে স্টাডিরুমের আলোর কিছুটা প্রিয়াংকাদের শোবার ঘরেও আসছে, তবুও ঘরটা অন্ধকার। স্যান্ডেল খুঁজে বের করতে অনেকক্ষণ মেঝে হাতড়াতে হলো। স্যান্ডেল পায়ে পরামাত্র পাশের ঘরে কিসের যেন একটা শব্দ হলো।
ভারী অথচ মৃদু গলায় কেউ একজন কাশল, ইজিচেয়ার টেনে সরাল। নিশ্চয়ই মনের ভুল। তবু প্রিয়াংকা আরো কিছুক্ষণ অপেক্ষা করল। নাআর কোনো শব্দ নেই। শুধু সদর রাস্তা দিয়ে দ্রুতবেগে ট্রাক যাওয়া-আসা করছে। তা হলে একটু আগে পাশের ঘরে কে শব্দ করছিল? অবিকল নিশ্বাস নেবার শব্দ। প্রিয়াংকা দরজা ঠেলে পাশের ঘরে ঢুকেই জমে পাথর হয়ে গেল। ইজিচেয়ারে জাভেদ বসে আছে। হাতে বই। জাভেদ বই থেকে মুখ তুলে তাকাল। নরম গলায় বলল, কিছু বলবে? কতটা সময় পার হয়েছে? এক সেকেন্ডের একশো ভাগের এক ভাগ, না অনন্তকাল? প্রিয়াংকা জানে না। সে শুধু জানে সে ছুটে চলে এসেছে শোবার ঘরে— ঝাঁপিয়ে পড়েছে বিছানায়। তার সমস্ত শরীর কাঁপছে সে কি অজ্ঞান হয়ে যাচ্ছে? নিশ্চয়ই অজ্ঞান হয়ে যাচ্ছে। ঘর দুলছে, চারদিকের বাতাস অসম্ভব ভারী ও উষ্ণ। জাভেদ জেগে উঠেছে। সে বিছানায় পাশ ফিরতে ফিরতে বলল, কী?
প্রিয়াংকা বলল, কিছু না। জাভেদ ঘুমজড়ানো স্বরে বলল, ঘুমাও। জেগে আছ কেন? বলতে বলতেই ঘুমে জাভেদ এলিয়ে পড়ল। জাভেদকে জড়িয়ে ধরে সারারাত জেগে রইল প্রিয়াংকা। একটি দীর্ঘ ও ভয়াবহ রাত। স্বামীকে জড়িয়ে ধরে প্রিয়াংকা শুয়ে আছে। তার সমস্ত ইন্দ্রিয় পাশের ঘরে। সে স্পষ্টই শুনছে ছোটখাটো শব্দ, ইজিচেয়ার থেকে উঠে দাঁড়ালে যেমন ক্যাঁচক্যাঁচ শব্দ হয় সেরকম শব্দ, গলার শ্লেষ্মা পরিষ্কার করার শব্দ। শেষরাতের দিকে শোনা গেল বারান্দায় পায়চারির শব্দ। কেউ-একজন। বারান্দার এ-মাথা থেকে ও-মাথায় যাচ্ছে আবার ফিরে আসছে। এইসব কি কল্পনা? নিশ্চয়ই কল্পনা। রাস্তা দিয়ে ট্রাক যাওয়ার শব্দ ছাড়া আর কোনো শব্দ আসছে না।