পরের মাসেও একই অবস্থা। তার পরের মাসেও তা-ই। হেডমাস্টার সাহেব মাথা দুলিয়ে বললেন, শিক্ষকতা হচ্ছে মহান পেশা। আত্মনিবেদন থাকতে হয়। শুধু টাকা টাকা করলে কি হয়?
অভাব-অনটনে বাবার জীবন পর্যদস্ত হয়ে গেল। চাকরির দরখাস্ত করেন—চাকরি পান না। এর মধ্যে বিয়েও করে ফেলেছেন। স্ত্রীকে নিজের কাছে এনে রাখার সামর্থ্য নেই। ঘোর অমানিশা। এই অবস্থায় কী মনে করে জানি ব্রিটিশ সরকারের বেঙ্গল পুলিশে সাব-ইন্সপেক্টরির পরীক্ষায় বসলেন। সেই সময়ের অত্যন্ত লোভনীয় এই চাকরিতে নির্বাচিত হবার জন্যে কঠিন সব পরীক্ষায় বসতে হত। তিনি পরীক্ষা দিতে বসলেন। গ্রহের ফেরে এই পরীক্ষায় প্রথম হয়ে গেলেন। ট্রেনিং নিতে গেলেন পুলিশ একাডেমী সারদায়।
জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত পুলিশের চাকরিটি তিনি নিষ্ঠার সঙ্গে করেছেন। বাবার মৃত্যুর পর দেখা গেল, এই জীবনে তিনি চার হাজারের মতো বই এবং পোস্টাপিসের পাশবই-এ একশত তিরিশ টাকা ছাড়া কিছুই রেখে যাননি। বইয়ের সেই বিশাল সংগ্রহও পাকিস্তান হানাদার বাহিনীর নির্দেশে পিরোজপুরের একদল হৃদয়হীন মানুষ লুট করে নিয়ে যায়। বাবাকে ধরে নিয়ে যায় বলেশ্বর নদীর তীরে। পাকিস্তান সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে বিদ্রোহের কারণে তাঁকে গুলি করে হত্যা করে। ভরা পূর্ণিমায় ফিনকি-ফোটা জ্যোৎস্নায় তার রক্তাক্ত দেহ ভাসতে থাকে বলেশ্বর নদীতে। হয়তো নদীর শীতল জল তার রক্ত সে-রাতে ধুয়ে দিতে চেষ্টা ভেবেছে। পূর্ণিমার চাদ তার সবটুকু আলো ঢেলে দিয়েছে তার ভাসন্ত শরীরে। মমতাময়ী প্রকৃতি পরম আদরে গ্রহণ করেছে তাকে।
এই প্রসঙ্গ থাক। এই প্রসঙ্গে আর লিখতে ইচ্ছে করছে না। বরং মার কথা বলি।
আমার মা
আমার মা ছিলেন তাঁর পরিবারের প্রথম সন্তান। শ্যামলা ধরনের একহারা গড়নের মেয়ে। অতি আদরের মেয়ে। কেমন করে জানি সবার ধারণা হল, এই মেয়ে তেমন বুদ্ধিমতী হয়নি। তাকে বুদ্ধিমতী বানানোর জন্যে ছোট বয়সেই পাঠিয়ে দেওয়া হল বারহাট্টায়। বারহাট্টায় আমার মার মামার বাড়ি। মার নানিজান অসম্ভব বুদ্ধিমতী। তিনি যদি ট্রেনিং দিয়ে এই মেয়েকে কিছুটা মানুষ করতে পারেন।
তাঁর ট্রেনিং-এ তেমন কাজ হল না। মার বুদ্ধি বিশেষ বাড়ল না। তবে ক্লাস টুতে তখন সরকারি পর্যায়ে একটি বৃত্তি পরীক্ষা হত। মা এই পরীক্ষা দিয়ে মাসে দুটাকা হারে বৃত্তি পেয়ে চারদিকে চমক সৃষ্টি করে ফেললেন। একি কাণ্ড! মেয়েমানুষ সরকারি জলপানি কী করে পায়?
মার দুর্ভাগ্য বৃত্তির টাকা তিনি পাননি। কারণ তাঁকে উপরের কোনো ক্লাসে ভরতি করানো হল না। মেয়েদের পড়াশোনার দরকার কী! চিঠি লিখতে পারার বিদ্যা থাকলেই যথেষ্ট। না থাকলেও ক্ষতি নেই। মেয়েমানুষের এত চিঠি
লেখালেখিরই-বা কী প্রয়োজন? তারা ঘর-সংসার করবে। নামাজ-কালাম পড়বে। এর জন্যে বাংলা-ইংরেজি শেখার দরকার নেই। তারচে বরং হাতের কাজ শিখুক। রান্নাবান্না শিখুক, আচার বানানো শিখুক, পিঠা বানানো শিখুক। বিয়ের সময় কাজে লাগবে।
আমার মা পড়াশোনা বাদ দিয়ে এইসব কাজ অতি যত্নের সঙ্গে শিখতে লাগলেন। তা ছাড়া নানিজান প্রতি বৎসর একটি করে পুত্র বা কন্যা জন্ম দিয়ে ঘর ভরতি করে ফেলছেন। তাঁর সর্বমোট বারোটি সন্তান হয়। বড় মেয়ে হিসেবে ছোট ছোট ভাইবোনদের মানুষ করার কিছু দায়িত্বও মার উপর চলে আসে।
এই করতে করতে একদিন তার বয়স হয়ে গেল পনেরো। কী সর্বনাশের কথা! পনেরো হয়ে গেছে এখনও বিয়ে হয়নি! বারহাট্টা থেকে কঠিন সব চিঠি আসতে লাগল যেন অবিলম্বে মেয়ের বিয়ের চেষ্টা করা হয়। চারদিকে সুপাত্র খোঁজা চলতে লাগল। একজন সুপাত্রের সন্ধান আনলেন মার দূর-সম্পর্কের চাচা, শ্যামপুরের দুদ মিয়া। দুদু মিয়াও পাগল ধরনের মানুষ। বি. এ. পাশ করেছেন। দেশ নিয়ে মাথা ঘামান। কী করে অশিক্ষিত মূখ মুসলমানদের রাতারাতি শিক্ষিত করা যায়, সেই চিন্তাতেই তার বেশির ভাগ সময় কাটে। শ্যামপুরের অতি দুর্গম অঞ্চলে তিন ইতিমধ্যে একটা স্কুল দিয়ে ফেলেছেন। সেই স্কুলে একদল রোগাভোগা ছেলে সারাদিন স্বরে অ, স্বরে আ বলে চঁাচায়। যে-মানুষটি এইসব কর্মকাণ্ডের মূলে তাঁর বিচারবুদ্ধির উপর খুব আস্থা রাখা যায় না। তবু আমার নানাজান তাকে ডেকে পাঠালেন। তাঁদের মধ্যে নিম্নলিখিত কথাবার্তা হয়?
ছেলে কী করে?
কিছু করে না। করার মধ্যে যা করে তা হল ন্যাশনাল লাইব্রেরিতে বসে সারাদিন বই পড়ে।
তুমি তাকে চেন কী করে?
দীর্ঘদিন তার সঙ্গে কলকাতার এক মেসে ছিলাম। তাকে খুব ভালো করে দেখার সুযোগ হয়েছে।
বাড়ির অবস্থা কী?
বাড়ির অবস্থা শোচনীয়।
ছেলের নামকরা আত্মীয়স্বজন কে আছেন?
কেউ নেই। সবাই হতদরিদ্র। তবে ছেলের বাবা উলা পাশ। বড় মৌলানা-অতি সজ্জন ব্যক্তি।
অতি সজ্জন ব্যক্তি দিয়ে কাজ হবে না। ছেলের মধ্যে তো তেমন কিছু দেখছি না। রাতদিন যে-ছেলে বই পড়ে সে আবার কেমন ছেলে বই পড়লে তো সংসার চলে না।
দুদু মিয়া খানিকক্ষণ গম্ভীর থেকে বললেন, এত ভালো ছেলে আমি আমার জীবনে দেখিনি এইটুকু বলতে পারি।
দেখতে কেমন?
রাজপুত্র!
কী বললে?
রাজপুত্র!
ছেলে দেখতে রাজপুত্রের মতো শুধু এই কারণেই নানাজান ছেলের বাবার সঙ্গে কথা বলতে রাজি হলেন। কথা বলে মুগ্ধ হয়ে গেলেন।
আমার দাদা মৌলানা আজিমুদ্দিন আহমেদের সঙ্গে কথা বলে মুগ্ধ হয়নি এমন মানুষ খুঁজে পাওয়া যাবে না। আরবি-ফারসিতে তার অগাধ জ্ঞান ছিল। অতি বিনয়ী মানুষ ছিলেন। মৃত্যুর পূর্বমুহূর্তে তিনি হাত তুলে যে-প্রার্থনা করেন তার থেকে মানুষটির চরিত্র স্পষ্ট হবে বলে আমার ধারণা। তিনি বলেন—