আমি এখন আমার বিচিত্র বাবা সম্পর্কে বলব। মৃত্যুপথযাত্রী মার প্রসঙ্গটা আপাতত থাক। শুধু এইটুকু বলে রাখি, তিনি দ্বিতীয়বার টাইফয়েডের ধাক্কাও সামলে ওঠেন জনৈক হিন্দু সাধুবাবার দেয়া তাৰ্পিন তেল খেয়ে। নিতান্তই অবিশ্বাস্য ব্যাপার। তাৰ্পিন টাইফয়েডের অষুধ নয়। নিশ্চয়ই অন্য কোনো ব্যাপার আছে। আমি যা শুনেছি তা-ই লিখলাম। সাধুবাবার ফুঁ-দেয়া তার্পিন খেয়ে মৃত্যুর মুখ থেকে কেউ ফিরে আসবে এই তথ্য হজম করা আমার পক্ষে বেশ কঠিন। যেহেতু মা দাবি করছেন, সেহেতু লিখছি।
এবার বাবার কথা বলি।
একজন অদ্ভুত বাবা
আমার ছোট ভাই মুহম্মদ জাফর ইকবাল তার লেখা প্রথম গ্রন্থ কপোট্রনিক সুখ দুঃখের উৎসর্গপত্রে লিখেছে ও।
পৃথিবীর সবচে ভালমানুষটিকে বেছে নিতে বললে
আমি আমার বাবাকে বেছে নেব।
বইয়ের উৎসর্গপত্রে লেখকরা সবসময় আবেগের বাড়াবাড়ি করেন। আমার ভাইয়ের এই উৎসর্গপত্র আবেগপ্রসূত ধরে নিতে খানিকটা অসুবিধা আছে। সে যদি লিখত পৃথিবীর সবচে ভালো মানুষ আমার বাবা এবং মা তা হলে আবেগের ব্যাপারটি চলে আসত। সে তা না করে বাবার কথাই লিখেছে। পৃথিবীর সবচে ভালোমানুষের মধ্যে মাকে ধরেনি। এর থেকেই বোঝা যাচ্ছে তার উৎসর্গপত্র আবেগপ্রসূত নয়। চিন্তাভাবনা করে লেখা। ইকবালকে আমি যতটুকু চিনি সে চিন্তাভাবনা না করে কখনো কিছু বলে না এবং লেখেও না।
আমার বাবা পৃথিবীর সবচে ভালো মানুষদের একজন কি না তা জানি না, তবে বিচিত্র একজন মানুষ, তা বলতে পারি। তার মতো খেয়ালি, তাঁর মতো আবেগবান মানুষ এখন পর্যন্ত আমার চোখে পড়েনি। আবেগ ছাড়াও তাঁর চরিত্রে আরও সব বিস্ময়ের ব্যাপারও ছিল। তিনি ছিলেন জন স্টেইনবেকের উপন্যাস থেকে উঠে-আসা এক রহস্যময় চরিত্র।
সবার আগে ছোট্ট একটা ঘটনা বলি। রাত প্রায় বারোটা। রঙমহল সিনেমা হল থেকে সেকেন্ড শো ছবি দেখে বাবা এবং মা রিকশা করে ফিরছেন। বড় একটা দিঘির পাশ দিয়ে রিকশা যাচ্ছে। মা হঠাৎ বললেন, আহা দ্যাখো কী সুন্দর দিঘি! টলটল করছে পানি। ইচ্ছে করছে পানিতে গোসল করি।
বাবা সঙ্গে সঙ্গে বললেন, রিকশা থামাও।
রিকশাওয়ালা থামল।
বাবা বললেন, চলো দিঘিতে গোসল করি।
মা হতভম্ব। এই গভীর রাতে দিঘিতে নেমে গোসল করবেন কী? নিতান্ত পাগল না হলে কেউ এরকম বলে?
মা বললেন, কী বলছ তুমি!
বাবা গম্ভীর গলায় বললেন, দ্যাখো আয়েশা, একটাই আমাদের জীবন। এই এক–জীবনে আমাদের বেশির ভাগ সাধই অপূর্ণ থাকবে। ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র যেসব সাধ আছে, যা মেটানো যায় তা মেটানোই ভালো। তুমি আসো আমার সঙ্গে।
বাবা হাত ধরে মাকে নামালেন। স্তম্ভিত রিকশাওয়ালা অবাক হয়ে দেখল হাত ধরাধরি করে দুজন নেমে গেল দিঘিতে।
এই গল্প যতবার আমার মা করেন ততবার তার চোখে পানি এসে যায়। তাঁর নিজের ধারণা, তাঁর জীবনে যে অল্প কিছু শ্রেষ্ঠ মুহূর্ত এসেছিল ঐ দিঘিতে অবগাহন তার মধ্যে একটি।
বাবার চরিত্রকে স্পষ্ট করার জন্যে আরও কিছু ঘটনার উল্লেখ করি। বাবা তখন সিলেট সদরে পুলিশের ইন্টেলিজেন্সিতে আছেন। পদমর্যাদায় সাব ইন্সপেক্টর। বেতন সর্বসাকুল্যে মাসে নব্বই টাকা। সেই টাকার একটা অংশ দেশের বাড়িতে চলে যায়, এক অংশ ব্যয় হয় বই কেনা বাবদ। বাকি যা থাকে তা দিয়ে অনেক কষ্টে সংসার চালিয়ে নিয়ে যান মা। যাকে বলে ভয়াবহ জীবনসংগ্রাম। জীবনসংগ্রামের এই অংশটি বাবার কখনো চোখে পড়ে না। কারণ দেশের বাড়িতে পাঠানো টাকা এবং বই কেনার টাকা আলাদা করে বাকি টাকাটা মার হাতে তুলে দেন। বাবার দায়িত্ব শেষ। বাকি মাস টেনে নিয়ে যাবার দায়িত্ব হচ্ছে মার। তিনি তা কীভাবে নেবেন সেটা তাঁর ব্যাপার। বাবার কোনোই মাথাব্যথা নেই।
এইরকম অবস্থায় মাসের প্রথম তারিখে বাবাকে খুব হাসিমুখে বাড়ি ফিরতে দেখা গেল। তিনি বিশ্বজয়-করা হাসি দিয়ে বললেন, আয়েশা, একটা বেহালা কিনে ফেললাম।
মা বিস্মিত হয়ে বললেন, কী কিনে ফেললে?
বেহালা।
বেহালা কীজন্যে?
বেহালা বাজানো শিখব।
কত দাম পড়ল?
দাম সস্তা, সত্তর টাকা। সেকেন্ড হ্যান্ড বলে এই দামে পাওয়া গেল।
বাবা সংসার চালাবার জন্য মার হাতে দশটা টাকা তুলে দিলেন; মা হাসবেন না কাঁদবেন ভেবে পেলেন না।
বাবার খুব শখ ছিল ওস্তাদ রেখে তাঁর কাছে বেহালা বাজানো শিখবেন। একাদকে বেতন দিয়ে বেহালা বাজানো শেখার সামর্থ্য তার ছিল না। কাজেই অতি যত্নে বেহালা তুলে রাখা হল। যেদিন সামর্থ্য হবে তখন ওস্তাদ রেখে বেহালা শেখা হবে।
মাঝে মাঝে দেখতাম কাঠের বাক্স থেকে তিনি বেহালা বের করছেন। অতি যতে ধুলো সরাচ্ছেন। হুড়ে রজন মাখাচ্ছেন এবং একসময় লাজুক ভঙ্গিতে বেহালায় হড় ঘষছেন। কান্নার মতো একরকম আওয়াজ উঠছে বেহালা থেকে। আমরা মুগ্ধ হয়ে শুনছি।
বাবার অসংখ্য অপূর্ণ শখের মতো বেহালা বাজানো শেখার শখও পূর্ণ হয়নি। বাক্সবন্দি থাকতে থাকতে একসময় বেহালার কাঠে ঘুণ ধরে গেল। দুড়ের সুতা গেল ছিড়ে। বেহালা চলে এল আমাদের দখলে। আমার ছোট বোন শেফ বেহালার বাক্স দিয়ে পুতুলের ঘর বানাল। বড় চমৎকার হল সেই ঘর। ডালা বন্ধ করে সেই ঘর হাতলে ধরে এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় নিয়ে যাওয়া যায়।
আরেক দিনের ঘটনা। শীতকালের এক ভোরে মার গলা শুনে ঘুম ভেঙে গেল। কী নিয়ে যেন বাবার সঙ্গে রাগারাগি করছেন। এরকম তো কখনো হয় না! তারা ঝগড়া-টগড়া অবশ্যই করেন, তবে সবটাই চোখের আড়ালে। আজ হল কী? আমি কান পেতে আছি যদি কিছু টের পাওয়া যায়। কিছুই টের পাওয়া যাচ্ছে না। মা বারবার শুধু বলছেন, ঘোড়া দিয়ে তুমি করবে কী? আমাকে বুঝিয়ে বলো, কে পুষবে এই ঘোড়া?