কোনো অধ্যবসায়ই বৃথা যায় না। সারের অধ্যবসায়ও বৃথা গেল না, আমাকে আটকে ফেললেন। সমকোণ কাকে বলে জিজ্ঞেস করলেন, আমি বলতে পারলাম না।
রাজকন্যাকে জিজ্ঞেস করলেন। সে-ও পারল না। না পারারই কথা। রাজকন্যারা সবসময়েই খানিকটা হাবা ধরনের হয়। স্যার রাজকন্যার দিকে তাকিয়ে বললেন–পড়া পারনি কেন?
রাজকন্যা জবাব দিল না। তার ছোট ছোট চোখ থেকে টপটপ করে পানি তে লাগল। সেই অশ্রুবর্ষণ-দৃশ্যে যে-কোনো পাষাণ দ্রবীভূত হবে। স্যার দ্রবীভূত হলেন। রাজকন্যাকে বসতে বললেন। আমার জন্যে শাস্তির ব্যবস্থা হল। বিচিত্র শাস্তি। বড় একটা কাগজে লেখা হল–
আমি পড়া পারি নাই।
আমি গাধা।
সেই কাগজ গলায় ঝুলিয়ে দেয়া হল। স্যার একজন দপ্তরিকে ডেকে আনলেন এবং কঠিন গলায় বললেন, এই ছেলেকে সবকটা ক্লাসে নিয়ে যাও। ছাত্ররা দেখুক।
আমি অপমানে নীল হয়ে গেলাম। টান দিয়ে গলার কাগজ ছিড়ে স্যারের দিকে তাকিয়ে তীব্র গলায় বললাম, আপনি গাধা। তারপর এক দৌড় দিয়ে ফুল থেকে বের হয়ে গেলাম। বাসায় ফিরে যাওয়ার প্রশ্ন ওঠে না। আমি শঙ্খনদীর তীর ঘেঁষে দৌড়াচ্ছি। আমাকে যেতে হবে অনেক অনেক দূরে। লোকালয়ে আমার থাকা চলবে না। কেউ যেন কোনোদিন আমাকে আর না দেখে।
সন্ধ্যাবেলা লোক পাঠিয়ে শঙ্খনদীর তীর থেকে বাবা আমাকে ধরিয়ে আনলেন। আমি আতঙ্কে কাঁপছি। না জানি কী শাস্তি অপেক্ষা করছে আমার জন্যে!
বাবা শান্ত গলায় বললেন, তুমি তোমার স্যারকে যা বলেছ তার জন্যে কি তুমি লজ্জিত।
আমি বললাম,–না।
বাবা দ্বিতীয়বার বললেন, তুমি আবার ভেবেচিন্তে বলল, তুমি কি লজ্জিত?
না।
লজ্জিত হওয়া উচিত। স্যারেরা তোমাকে পড়ান। তোমাদের শাস্তি দেয়ার অধিকার তাদের আছে। তুমি আমার সঙ্গে চলো। স্যারের কাছে ক্ষমা চাইবে।
আমি বাবার সঙ্গে কাঁদতে কাঁদতে রওনা হলাম। স্যারের কাছে ক্ষমা চাইলাম। আমার ক্ষমা প্রার্থনার পর বাবা বললেন, মাস্টারসাহেব, আমার এই ছেলেটা খুব অভিমানী। সে বড় ধরনের কষ্ট পেয়েছে। অপমানিত বোধ করেছে। তাকে আমি কোনোদিন এই স্কুলে পাঠাব না। সে বাসায় থাকবে।
কী বলছেন আপনি।
আমার ছেলের অপমনি আমার কাছে অনেক বড় ব্যাপার। বাবা আমাকে কোলে নিয়ে বাসায় ফিরলেন। পরদিন হেডমাস্টার সাহেবকে সঙ্গে নিয়ে স্কুকের সব শিক্ষক বাসায় উপস্থিত। তারা বাবাকে রাজি করাতে এসেছেন যাতে আমি আবার স্কুলে যাই। বাবা রাজি হলেন না। তাঁর এক কথা, আমি তাকে স্কুলে পাঠাব না।।
সারাদিন একা একা বাসায় থাকি। কিছুতেই সময় কাটে না। ছোট্ট দুই ভাইবোন স্কুলে। মা ব্যস্ত। আমার কিছু করার নেই। আমি স্কুলের সা শঙ্খনদীর তীর ঘেঁষে হেঁটে হেঁটে কাটাই।
বাবা মাঝে মাঝে আমাকে ট্যুরে নিয়ে যান। কখনো রামু, কখনো থানছি, কখনো নাইক্ষ্যংছড়ি। আমাকে সঙ্গে নিয়ে ঘোরার পেছনে বাবার যে-উদ্দেশ্য কাজ করছিল তা হল প্রকৃতির রূপের দিকে আমার চোখ ফেরানো। তিনি আমাকে মোটা একটা খাতা এবং কলম দিলেন যাতে আমি কী কী দেখছি তা গুছিয়ে লিখি। একদিন খাতা দেখতে চাইলেন।
যা যা লেখা হয়েছে তা পড়ে বড়ই বিরক্ত হলেন। প্রকৃতি সম্পর্কে খাতায় কিছুই লেখা নেই। যা লেখা তা পড়ে বিরক্ত হওয়া স্বাভাবিক। একটা উদাহরণ দিলেই পরিষ্কার হবে।
মঙ্গলবার।
আজ আমরা রামু থানায় পৌঁছিয়াছি।
দুপুরে ভাত খাইয়াছি। মুরগির গোশত এবং আলু।
ডাল ছিল। ভাল খাই নাই।।
বাবা বললেন, তুই কী দিয়ে ভাত খেলি তা বিতং করে লেখার কী দরকার? অন্যরা এই খবর জেনে কী করবে?
আমি গম্ভীর গলায় বললাম, অন্যদের জন্যে তো আমি লিখি নাই। আমি লিখেছি আমার জন্য।
কোনদিন কী খেয়েছিস তার খোঁজেই-বা তোর কী দরকার? এই যে এত সুন্দর জলপ্রপাত তোকে দেখিয়ে আনলাম সেই প্রপাতটার কথা লিখলি না কেন?
জলপ্রপাতের কথা লিখলে কী হবে?
যারা জলপ্রপাতটা দেখেনি তারা তোর লেখা পড়ে বুঝবে জিনিসটা কেমন। যা, লিখে নিয়ে আয়। দেখি পারিস কি না।
সেই জলপ্রপাত আমাকে মোটেই আকর্ষণ করেনি। ছোট্ট পানির ধারা উপর থেকে নিচে পড়ছে। নিচে গর্ত মতো হয়েছে। গর্ত ভরতি ঘোলা পানি। জলপ্রপাতের একটি জিনিস আমার ভালো লাগল–পানির ধারার চারদিকে সূক্ষ্ণ জলচূর্ণের জন্যে অসংখ্য রামধনু দেখা যায়। আমি রামধনু সম্পর্কেই লিখলাম। আশ্চর্যের ব্যাপার হচ্ছে–ষষ্ঠ শ্রেণীর একটি বালকের সেই লেখা পড়ে আমার সাহিত্যিক বাবা মুগ্ধ হয়ে গেলেন। শুধু মুগ্ধ না—প্রায় অভিভূত হবার মতো অবস্থা।
জলপ্রপাতবিষয়ক রচনার কারণে উপহার পেলাম–রবীন্দ্রনাথের ‘গল্পগুচ্ছ’। গল্পগুচ্ছের প্রথম যে-গল্পটি পড়ি তার নাম ‘মেঘ ও রৌদ্র’। পড়া শেষ করে অনেকক্ষণ কাঁদলাম। তারপর চোখ মুছে আবার গোড়া থেকে পড়া শুরু করলাম। আমার নেশা ধরে গেল।
বান্দরবন পুলিশ লাইব্রেরিতে অনেক বই।
বাবা সেই লাইব্রেরির সেক্রেটারি। রোজ বই নিয়ে আসেন। আমি সারাদিন পড়ি। মাঝে মাঝে অসহ্য মাথার যন্ত্রণা হয়। সেই যন্ত্রণা নিয়েও পড়ি। বিকেলে শঙ্খনদীর তীরে বেড়াতে যাই।
নদীর তীরেই আমার পরিচয় হল নিশাদাদার সঙ্গে। তাঁর ভালো নাম নিশানাথ ভট্টাচার্য, তার বাবা পুলিশের এ.এস.আই,। নিশাদাদা বিরাট জোয়ান। কয়েকবার ম্যাটিক দিয়েছেন–পাশ করতে পারেননি। পড়াশোনায় তাঁর কোনো মন নেই, তাঁর মন শরীরচর্চায়। নদীর তীরে তিনি ঘণ্টাখানিক দৌড়ান। ডন বৈঠক করেন। শেষ পর্যায়ে সারা গায়ে ভেজা বালি মেখে নদীর তীরে শুয়ে থাকেন। এতে নাকি রক্ত ঠাণ্ডা হয়। রক্ত ঠাণ্ডা হওয়া শরীরের জন্য ভালো।