আরও দুদিন কাটল। কুকুরটি চোখের সামনে পচেগলে যা।চ্ছে। তার কাতরধ্বনি সহ্য করা মুশকিল। গা থেকে গলিত মাংসের দুর্গন্ধ আসছে।
বাবা মাকে ডেকে বললেন, আমি এর কষ্ট সহ্য করতে পারছি না। তুমি বন্দুক বের করে আমাকে দাও।।
বাবা আমাদের চোখের সামনে পরপর দুটি গুলি করে কুকুরটিকে মারলেন। শান্ত গলায় বললেন, যে আমার কাজলের জীবন রক্ষা করেছে তাকে আমি গুলি করে মারলাম। একে বলে নিয়তি
আমার কাছে বাবাকে পৃথিবীর নিরতম মানুষদের একজন বলে মনে হল। নিজেকে কিছুতেই বোঝাতে পারছিলাম না এমন একটি কাজ তিনি কী করে করতে পারলেন। রাগে দুঃখে ও অভিমানে রাতে ভাত না খেয়ে শুয়ে পড়েছি। বাবা আমাকে ডেকে নিয়ে বারান্দায় বসালেন।
দুজন চুপচাপ বসে আছি। চারদিকে ঘন অন্ধকার। তক্ষক ডাকছে। বাড়ির চারপাশের আমের বনে হাওয়া লেগে বিচিত্র শব্দ উঠছে।
বাবা কিছুই বললেন না। হয়তো অনেক কিছুই তার মনে ছিল। মনের ভাব প্রকাশ করতে পারলেন না। একসময় বললেন, যাও ঘুমিয়ে পড়ো।
কুকুরটি আমার মনে গভীর ছাপ ফেলেছিল।
আমার মনে আছে–এই নিয়ে আমি কিছু-একটা লিখতে চেষ্টাও করেছিলাম। রচনাটির নাম দিয়েছিলাম বেঙ্গল টাইগার কিংবা আমাদের বেঙ্গল টাইগার। সম্ভবত এই রচনাই আমার প্রথম সাহিত্য। বলাই বাহুল্য, অতি তুচ্ছ রচনা। কিন্তু হৃদয়ের গভীর যাতনায় যার জন্ম তাকে তুচ্ছই-বা করি কী করে?
জগদলে বেশিদিন থাকা হল না। বাবা বদলি হলেন দিনাপুরের পচাগড়ে [পঞ্চগড়]। এই জায়গা সম্পর্কে আমার বিশেষ কিছু মনে নেই, শুধু মনে আছে ভোরবেলা বাসার সামনে এসে দাঁড়ালে কাঞ্চনজঙ্ঘার ধবল চুড়া দেখা যেত। মনে হত পাহাড়টা রূপার পাতে মোড়া। সূর্যের আলো পড়ে সেই রূপা চকচক করছে। বাবা আমাদের মধ্যে সাহিত্যবোধ জাগ্রত করবার জন্যেই হয়তো এক ভোরবেলায় ঘোষণা করলেন, কাঞ্চনজঙ্ঘাকে নিয়ে যে একটা কবিতা লিখতে পারবে সে চার আনা পয়সা পাবে। অনেক চেষ্টা করেও কোনো কবিতা দাঁড় করাতে পারলাম না। মনটা খুবই খারাপ হয়ে গেল। আরও মন-খারাপ হল যখন আমাদের তিন ভাইবোনকে স্কুলে ভরতি করিয়ে দেয়া হল।
স্কুলে ভরতি করতে নিয়ে গেলেন বড়মামা। তিনজনই কাঁদতে কাঁদতে যাচ্ছি। এই পৃথিবীর হৃদয়হীনতা কেউই সহ্য করতে পারছি না। বড়মামা উপদেশ দিতে দিতে নিয়ে যাচ্ছেন–বিদ্যা অমূল্য ধন, পড়াশোনা করে যে, গাড়ি-ঘোড়া চড়ে সে-এইসব।
অমূল্য ধন বা গাড়ি-ঘোড়া কোনোকিছুরই প্রতি আকর্ষণ বোধ করছি না।
বড়মামা আমাদের চোখের জল অগ্রাহ্য করে স্কুলে ভরতি করিয়ে দিলেন। শুধু তা-ই নয়, হেডমাস্টার সাহেবকে বললেন, আপনাদের যদি আপত্তি না থাকে আমি বিনা বেতনে আপনাদের স্কুলে পড়াব। আপাতত আমার কিছু করার নেই, হাতে প্রচুর অবসর।
হেডমাস্টার রাজি হলেন। আমি খানিকটা আশার আলো দেখতে পেলাম। যা-ই হোক, একজন স্যার হলেন আমাদের নিজেদের লোক এবং অতি প্রিয় মানুষ। স্কুলের দিনগুলি হয়তো খারাপ যাবে না। দ্বিতীয় দিনেই বড়মামা আমাদের ক্লাসে অঙ্ক করাতে এলেন। আমি হাসিমুখে চেঁচিয়ে উঠলাম-বড়মামা?
মামার মুখ অন্ধকার হয়ে গেল। হুংকার দিয়ে বললেন-মমা? মামা মানে? চড় দিয়ে সব দাঁত খুলে ফেলব। স্কুলে আমি তোমাকে চিনি না। তুমিও আমাকে চেন না। বলো, ৬-এর ঘরের নামতা বলো। পাঁচ ছয় কত?
আমি হতভম্ব।
একি বিপদ! ছয়ের ঘরের নামতা যে জানি না এটা বড়মামা খুব ভালো করেই জানেন। কারণ তিনি আমাদের পড়ান।
তিনি দুনিয়া-কাঁপানো হুংকার দিলেন, কী, পারবে না?
আবার কী? বলো, জি না।
জি না।
বলো, জি না স্যার।
জি না স্যার।
না পারার জন্যে শাস্তির ব্যবস্থা হবে। আত্মীয় বলে আমার কাছ থেকে পার পাওয়া যাবে না। আমার চোখে সব সমান। সবাই ছাত্র। ক্লাস-ক্যাপ্টেন কোথায়? যাও, বেত নিয়ে আসো।
বেত আনা হল। এবং সত্যি সত্যি বড়মামা ছয়টি বেতের বাড়ি দিলেন–যেহেতু ছয়ের ঘরের নামতা।
স্কুলে মোটামুটি আতঙ্কের সৃষ্টি হয়ে গেল। ছাত্রমহলে রটে গেল ভয়ংকর রারী একজন স্যার এসেছেন। অতি কড়া, তার ক্লাসে নিশ্বাস ফেলা যায় না
বড়মামার চাকরি দীর্ঘস্থায়ী হল না। স্থানীয় এস.ডি.ও. সাহেবের ছোট ভাইকে কানে ধরে উঠবস করার কারণে তার চাকরি চলে গেল। আমরা হাঁপ ছেড়ে বাঁচলাম। বড়মামা আবার আগের মূর্তিতে ফিরে এসেছেন। গল্প করছেন, আমাদের নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছেন। কোথায় গেলে নাকি রাতের বেলা দার্জিলিং শহরের বাতি দেখা যায়, নিয়ে গেলেন।
গভীর রাত পর্যন্ত অন্ধকারে দাঁড়িয়ে শীতে কাঁপছি। দার্জিলিং শহরের বাতি আর দেখছি না। উপরের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে ঘাড় ব্যথা হয়ে গেল। কিছুই দেখা গেল না। বড়মামা বিরক্ত হয়ে বললেন, ওদের আজ বোধহয় ইলেকট্রিসিটি ফেল করেছে। আরেকদিন আসতে হবে। অসাধারণ দৃশ্য! না দেখলে জীবন বৃথা।
একদিন সাইকেলের সামনে বসিয়ে আমাকে নিয়ে গেলেন পাহাড়ি নদী দেখাতে। প্রায় চার-পাঁচ ঘণ্টা সাইকেল চালিয়ে নালার মতো একটা জলধারা পাওয়া গেল। মামা বললেন, তুমি ঘুরে বেড়াও। আমি এই ফাঁকে একটা কবিতা লিখে ফেলি। মামা নদীর পাড়ে বসে কুলটানা খাতায় কবিতা লিখতে বসলেন। দীর্ঘ কবিতা লেখা হল। কবিতার নামটা মনে আছে।
হে পাহাড়ী নদী।
বড়মামার এই কবিতা স্থানীয় একটি পত্রিকায় ছাপাও হল। পচাগড়ের দিনগুলি আমাদের কাছে একসময় সহনীয় হয়ে উঠল এবং ভালো লাগতে লাগল। আমার একজন বন্ধু জুটে গেল যে নর্দমার পানিতে মাছ মারার ব্যাপারে একজন বিশেষজ্ঞ। দুজনেই বড়শি-হাতে নর্দমায় নর্দমায় ঘুরে বেড়াই। নর্দমায় ট্যাংরা, লাটি এবং পুঁটিমাছ পাওয়া যায়। আমার বন্ধুর পকেটে নারিকেলের মালায় থাকে কেঁচো। সে পকেটে হাত ঢুকিয়ে এক টুকরা কেঁচো নিয়ে মুহূর্তের মধ্যে বড়শিতে গেঁথে পানিতে ফেলে দেয়। দেখতে বড় ভালো লাগে।
শেষ পর্বে শঙ্খনদী
পচাগড় থেকে বাবা বদলি হলেন রাঙ্গামাটিতে।