ব্যথিত মা করুণচোখে ছেলের দিকে তাকিয়ে উঠে চলে যাচ্ছে।
ভিখিরিণীর হাত থেকে বাঁচার জন্যে গনি চাচা কয়েকবার বাড়িবদল করলেন। কোনো লাভ হল না। যেখানেই যান সেখানেই মা উপস্থিত হয় সারাদিন বারান্দায় বসে থাকে।
শেষটায় গনি চাচা চেষ্টা-চরিত্র করে সিলেট থেকে বদলি হয়ে গেলেন। মৌলভী বাজার। হতদরিদ্র মার হাত থেকে ছিনিয়ে নিলেন একটি শিশু। আমার তখন বয়স অল্প, খুবই অল্প। পৃথিবীর জটিলতা বোঝার বয়স নয়, তবুও মনে হল-এটা অন্যায়। খুব বড় ধরনের অন্যায়। ঐ ভিখিরিণী-মার সঙ্গে মাঝে মাঝে আমার দেখা হত। আমি তার পেছনে পেছনে হাঁটতাম। বিড়বিড় করে সে নিজের মনে কথা বলত। নিজের দুপাশে থুথু ফেলতে ফেলতে এত। হয়তো তার মাথা-খারাপ হয়েছিল। একজন ভিখিরিণীর মাথা-খারাপ হওয়া এমন কোনো বড় ঘটনা নয়। জগৎসংসারের তাতে কিছুই যায় আসে না। পৃথিবী চলে তার নিজস্ব নিয়মে। সেইসব নিয়ম জানার জন্য একধরনের ব্যাকুলতা আমার মধ্যে হয়তো তৈরি হয়েছিল। অনেক ধরনের প্রশ্ন মনে আসত। কাউকে করতে পারতাম না। প্রশ্নগুলির উত্তর নিজের মনেই খুঁজতে হত।
মৃত্যুর পর মানুষ কোথায় যায়-এই প্রশ্নটা একদিন মনে এল। ভালো মানুষেরা বেহেশতে, খারাপ মানুষেরা দোজখে-এ সহজ উত্তর মনে ধরল না। মনে হল-উত্তর এত সহজ নয়। মৃত্যু-সম্পর্কিত জটিল প্রশটি মনে আসার কারণ আছে। কারণটা বলি।
একদিন সিলেট সরকারি হাসপাতালের সামনে দিয়ে আসছি। হঠাৎ দেখি নর্দমায় একটি মৃতদেহ পড়ে আছে। লোকজন ভিড় করে দেখছে। কৌতূহল মিটে গেলে চলে যাচ্ছে। আমিও দেখতে লাগলাম। মৃতদেহ দেখে আমার শরীর কাঁপতে লাগল। কারণ মৃত মানুষটির ঠোঁটে হাসি। তার চোখ বন্ধ, কিন্তু হাসি, ভঙ্গিতে ঠোঁট বেঁকে আছে। দেখেই মনে হয় কোনো-একটা মজার ঘটনায় চোখ বন্ধ করে সে হাসছে। আমার বুকে ধক করে ধাক্কা লাগল।
দৌড়ে পালিয়ে এলাম।
মৃতদেহটির হাসিহাসি-মুখের ছবি নিজের মন থেকে কিছুতেই মুছতে পারলাম না। বিকেলে আবার দেখতে গেলাম। মৃতদেহ আগের জায়গাতেই আছে। তার মুখের হাসিরও কোনো হেরফের হয়নি।
পরদিন আবার গেলাম। লাশ সরানো হয়নি। তবে মুখের হাসি আর চোখে। পড়ল না। অসংখ্য লাল পিপড়ায় সারা শরীর ঢাকা। লোকটির গায়ে যেন লাল রঙের একটা চাদর। খুব ইচ্ছা করল চাদর সরিয়ে তার মুখটি আরেকবার দেখি। দেখি, এখনও কি সেই মুখে হাসি লেগে আছে?
আমি বাসায় ফিরলাম কাঁদতে কাঁদতে। বাসায় ফিরেই শুনি, বাবার চিঠি এসেছে—আমরা সিলেটে আর থাকব না। চলে যাব দিনাজপুর, জায়গাটার নাম জগদল। মৃত মানুষটির কথা আর মনে রইল না। আনন্দে লাফাতে লাগলাম।
মৃত লোকটির কথা আর মনে রইল না-বলাটা বোধহয় ঠিক হল না। মনে ঠিকই রইল, তবে চাপা পড়ে গেল। একমাত্র শিশুরাই পারে সব ঘটনা সহজ ভঙ্গিতে গ্রহণ করে ঢাকনা দিয়ে ঢেকে রাখতে। তারা একটি স্মৃতি থেকে অতি দ্রুত চলে যেতে পারে অন্য স্মৃতিতে। সব আলাদা আলাদা রাখা। ঢাকনা দিয়ে ঢাকা। মাঝে মাঝে ঢাকনার মুখ তুলে দেখে নেয় সব ঠিকঠাক আছে কি না। কোনোকিছুই সে নষ্ট করতে বা ফেলে দিতে রাজি না।
কষ্টকর স্মৃতি মুছে ফেলার আপ্রাণ চেষ্টা আমি শুধু বড়দের মধ্যেই দেখি। শিশুদের মধ্যে দেখি না।
আমার বন্ধু উনু
উনর সঙ্গে আমার পরিচয় ফুটবল খেলার মাঠে। রোগা টিঙটিঙে একটা ছেলে–বড় বড় চোখ, খাদা নাক, মাথাভরতি ঝাঁকড়া চুল।
দুদলে তমূল খেলা চলছে। আমি মাঠের বাইরে। গায়ে জ্বর বলে খেলতে পারছি না। জ্বর এমন বাড়াবাড়ি যে বসে থাকতে পারছি না আবার উঠে চলে অতেও পারছি না। এমন সময় উনুকে লক্ষ্য করলাম। যে খুব মন দিয়ে ঘাস খাচ্ছে।
সত্যি সত্যি ঘাস পাচ্ছে। দুআঙুলে ঘাসের কচি পাতা দ্রুত তুলে চপচপ শব্দে চিবিয়ে খাচ্ছে। আমি অবাক হয়ে বললাম, ঘাস খাচ্ছ কেন?
সে গম্ভীর গলায় বলল, আমার ইচ্ছা।
বলে পুরো সুফি-সাধকদের নির্লিপ্ততা নিয়ে ঘাস চিবুতে লাগল। এমনভাবে চিবুচ্ছে যেন অতি উপাদেয় কোনো খাবার। তার খাওয়া দেখে জিভে পানি চলে আসে। আমি কৌতূহল সামলাতে পারলাম না। দ্বিতীয়বার জিজ্ঞেস করলাম, ঘাস খাচ্ছ কেন?
সে উদাস গলায় বলল, ভাইটামিন আছে।
এরকম একটি ছেলের সঙ্গে বন্ধুতু না হওয়ার কোনো কারণই নেই। দশ মিনিটের মাথায় আমরা জন্মের বন্ধু হয়ে গেলাম। সে শিখিয়ে দিল ঘাসের কোন অংশ খেতে হয়, কোন অংশ খেতে হয় না। দুটা পাতার মাঝখানে সুতার মতো যে-ঘাসটা বের হয় সেটাই খাদ্য, তবে ডগার খানিকটা বাদ দিতে হবে। ডগাটা বিষ।
উনু আমার চেয়ে এক ক্লাস উপরে পড়ে। আমাদের স্কুলে না, অন্য কী-একটা স্কুলে। তার মা নেই, বাবার সঙ্গে থাকে। বাবা প্রতিদিন রুটিন করে উনুকে দুবেলা মারেন। স্কুল থেকে ফিরে আসার পর একবার, সন্ধ্যাবেলা খেলার মাঠ থেকে ফিরে আসার পর একবার। সেই মারও দর্শনীয় মার। তবে মজার ব্যাপার হচ্ছে, মারপর্ব শেষ হবার পরই দুজনই অতি ঘনিষ্ঠ বন্ধু। যেন কিছুই হয়নি।
উনুর বাবা ছোট চাকরি করতেন। বাসার সাজসজ্জা অতি দরিদ্র। বাঁশের বেড়ার ঘর। পাশেই ডোবা। ময়লা নোংরা পানি। খেলা শেষ করে বাসায় ফিরে উনু সেই নোংরা পানিতে দিব্যি হাত-মুখ ধুয়ে ফেলে।
উনুর বাবাকে মানুষ হিসেবে আমার খুব পছন্দ হল। ছোটদের সঙ্গে কথা বলেন এমনভাবে যেন তারা ছোট না। তার সমবয়স্ক মানুষ। আমাকে একদিন বললেন, এই যে আই আই চুন্দ্রীগর সাহেব দেশের ভার নিল, লোকটা কেমন?