আমি নিজে নানাভাবে বড়মামার কাছে ঋণী। গল্প বলে মানুষকে মন্ত্রমুগ্ধ করে ফেলার দুর্লভ ক্ষমতা তার ছিল। তার এই ক্ষমতা আমাকে বারবার বিস্মিত করত। একই গল্প যখন বড়মামার কাছে শুনতাম, তখন অন্যরকম হয়ে যেত। এর কারণ বুঝতে পারতাম না, তবে কারণ নিয়ে ভাবতাম এটা মনে আছে। জীবনের প্রথম ছবি আঁকা তার কাছ থেকেই শিখি। তিনি হাতি আঁকাব চমৎকার একটা সহজ কৌশল শিখিয়ে দিলেন। এই কৌশলে আমি তিন হাজারের মতো হাতি এক মাসের মধ্যে এঁকে ফেলি। বাড়ির সাদা দেয়াল পেনসিলে আঁকা হাতিতে হাতিময় হয়ে যায়।
তার একটা সাইকেল ছিল। সারাদিন সাইকেলে করে ঘুরতেন। মাঝে মাঝে আমাকে পেছনে বসিয়ে বেড়াতে বের হতেন। সাইকেল চলত ঝড়ের গতিতে। এই সাইকেল বড়মামার প্রতিভার স্পর্শ পেয়ে একদিন মোটরসাইকেল হয়ে গেল। যখনই সাইকেল চলে ভটভট শব্দ হয়। লোকজন অবাক হয়ে তাকায়। দেখতে সাইকেল অথচ শব্দ হচ্ছে মোটরসাইকেলের, ব্যাপারটা কী? ব্যাপার কিছুই না, দুটুকরা শক্ত পিসবোর্ড সাইকেলের সঙ্গে এমনভাবে লাগানো যে চাকা ঘোরামাত্র শোকের সঙ্গে পিসবোর্ডের ধাক্কা লেগে ভটভট শব্দ হয়। শিশুরা প্রতিভার সবচেয়ে বড় সমঝদার। আমরা বড়মামার প্রতিভার দীপ্তি দেখে বিস্মিত। আমাদের বিস্ময় আকাশ স্পর্শ করল যখন তিনি হাঙ্গার স্ট্রাইক শুরু করলেন। হাঙ্গার স্ট্রাইকের কারণ মনে নেই, শুধু মনে আছে দরজার গায়ে বড় বড় করে লেখা-আমরণ অনশন। নীরবতা কাম্য। তিনি একটা খাটে শবাসনের ভঙ্গিতে শুয়ে আছেন। বাবা পুরো ব্যাপারটায় মজা পেয়ে খুব হাসাহাসি করছেন। বড়মামা তাতে মোটেই বিচলিত হচ্ছেন না। তার হাঙ্গার স্ট্রাইক ভাঙানোর কোনো উদ্যােগ নেয়া হল না। একদিন কাটল, দুদিন কাটল, তৃতীয় দিনও পার হল। তখন সবার টনক নড়ল। মা কান্নাকাটি শুরু করলেন। বাড়িতে টেলিগ্রাম গেল। চতুর্থ দিন সন্ধ্যায় বড়মামা এক গ্লাস শরবত খেয়ে অনশন ভঙ্গ করলেন এবং গম্ভীর গলায় ঘোষণা করলেন-এদেশে থাকবেন না। কোনো ভদ্রলোকের পক্ষে এদেশে থাকা সম্ভব নয়। তিনি বিলেত যাবেন।
তখন বিলেত যাওয়া খুব সহজ ছিল। দলেদলে সিলেটিরা বিলেত যাচ্ছে। মামারও পাসপোর্ট হয়ে গেল। তিনটি নতুন স্যুট বানানো হল। মামা স্যুট পরে ঘোরাফেরা করেন। আমরা মুগ্ধ বিস্ময়ে দেখি। কাঁটাচামচ দিয়ে ভাত-মাছ খান। দেখতে বড় ভালো লাগে।
শেষ পর্যন্ত বিলেত যাওয়া হল না। মামা বললেন—আরে দূর দূর, দেশের উপর জিনিস নাই। বিদেশ গিয়ে আমি ঘাস কাটব নাকি? আমি ভালোই আছি। বাবা বিস্মিত হয়ে বললেন, তুমি তা হলে যাচ্ছ না?
জি না।
কী করবে কিছু ঠিক করেছ?
আই. এ. পরীক্ষা দেব। এইবার উড়াউড়া শুনেছি ম্যাক্সিমাম পাশ করবে। পরীক্ষা অবশ্য দিলেন না, কারণ পরীক্ষার আগে-আগে খবর পেলেন, এইবাব কোশ্চেন খুব টাফ হবে। গতবার ইজি হয়েছিল, এইবার টাফ। টাফ কোশ্চেনে পরীক্ষা দেয়ার কোনো মানে হয় না।
তিনি একটা ক্যারামবোর্ড কিনে ফেললেন। মামা এবং চাচা দুজনে মিলে গভীর রাত পর্যন্ত টুকুস টুকুস করে ক্যারাম খেলেন। বড় সুখের জীবন তাদের।
আমার জীবনও সুখের, কারণ বাসার প্রধান শাসক বাবা অনুপস্থিত। তিনি প্রমোশন পেয়ে পুলিশ ইন্সপেক্টর হয়েছেন। তাকে বদলি করা হয়েছে। দিনাজপুরের জগদলে। সেই সময় বর্ডাররক্ষার দায়িত্ব ছিল পুলিশের উপর। বাবা চলে গেলেন বর্ডারে। আমার পূর্ণ স্বাধীনতা। কারওরই কিছু বলার নেই।
সেই সময় দেশে বড় ধরনের খাদ্যাভাব দেখা দিল। ভয়াবহ অবস্থা। হাজার হাজার মানুষ খাবারের সন্ধানে শহরে জড়ো হয়েছে। থালা-হাতে বাড়ি বাড়ি ঘুরছে।
সিলেট শহরে অনেকগুলি লঙ্গরখানা খোলা হল। লঙ্গরখানায় বিরাট ডেকচিতে খিচুড়ি রান্না করা হয়। ক্ষুধার্ত মানুষদের একবেলা খিচুড়ি খাওয়ানো হয়।
আমি মন্ত্রমুগ্ধের মতো ওদের খাওয়া দেখি। কলার পাতা কেটে লাইন ধরে সবাই বসে। প্রত্যেকের পাতায় দুহাতা করে খিচুড়ি দেয়া হয়। কত আনন্দে, কত আগ্রহ নিয়েই-না তারা সেই খিচুড়ি খায়! ওদের আনন্দে ভাগ বসানোর জন্যই হয়তোবা এক দুপুরে কলার পাতা নিয়ে ওদের সঙ্গে খেতে বসে গেলাম। সেই খিচুড়ি অমৃতের মতো লাগল। এর পর থেকে রোজই দুপুরবেলায় লঙ্গরখানায় খেতে যাই। একদিন বোনকেও নিয়ে গেলাম। সেও মহানন্দে কলার পাতা নিয়ে আমার সঙ্গে বসে গেল। খাওয়ার মাঝামাঝি পর্যায়ে এক ভদ্রলোক বিস্মিত হয়ে আমাদের দু-ভাইবোনের সামনে এসে দাঁড়ালেন। কণ্ঠে রাজ্যের বিস্ময় নিয়ে বললেন, এরা কারা?
ধরা পড়ে গেলাম। কানে ধরে আমাদের দুজনকে বাসায় নিয়ে যাওয়া হল। আমার মা ক্রমাগত কাঁদতে লাগলেন। লঙ্গরখানায় খাওয়ার অপমানে তার নাকি মাথাকাটা যাচ্ছে। লঙ্গরখানায় আমি পাতা পেতে খেয়েছি এতে লজ্জিত বা অপমানিত বোধ করার কী আছে তা আমি ঐদিন বুঝতে পারিনি। আজও পানি না।
নিঃসন্তান গনি চাচার জীবনে এই সময় একটি বড় ঘটনা ঘটল। এক ভিখিরি-মা ছেলে কোলে নিয়ে এসেছে ভিক্ষা করতে। ফুটফুটে ছেলে। গনি চাচার ছেলেটাকে বড়ই পছন্দ হল। তিনি প্রস্তাব দিলেন ছেলেটাকে তিনি আদরযত্নে বড় করবেন, তার বিনিময়ে ভিখিরি-মা দশ টাকা পাবে। কিন্ত কোনোদিন এই ছেলেকে তার ছেলে বলে দাবি করতে পারবে না। মা রাজি হয়ে গেল।
এই ঘটনা আমার মনে বড় ধরনের ছাপ ফেলে।
এখনও চোখের সামনে স্পষ্ট দেখি, ভিখিরি-মা মুখ কালো করে ঘরের বারান্দাতে বসে আছে। গনি চাচার স্ত্রী তার ছেলে-কোলে বারান্দায় এসে ধমকাচ্ছেন-কী চাও তুমি? তোমাকে না বলেছি, কখনো আসবে না! কেন এসেছ?