যতই দিন যেতে লাগল এদের রমরমা সমসমা বাড়তেই লাগল। শুনলাম, তাদের জন্যে বিশাল দুতলা বাড়ি তৈরি হচ্ছে। বাড়ি তৈরি না হওয়া পর্যন্ত কোনোরকম কষ্টেসৃষ্টে এখানেই থাকবে। এর মধ্যে এই দুই ভাইবোনের জন্মদিন হল। জন্মদিন বলে যে একটা ব্যাপার আছে আমার তা জানা ছিল না। এই দিনে উৎসব হয়। খানাদানা হয়-উপহার নিয়ে লোকজন আসে কে জানত! আমরা অভিভূত।
শেফু একদিন বাবাকে গিয়ে বলল, আমার জন্মদিন করতে হবে।
বাবা খানিকক্ষণ তার দিকে তাকিয়ে থেকে বললেন, ঠিক আছে মা, করা হবে। কিন্তু শুধুই একবার। এই উৎসব আমি দ্বিতীয়বার করব না। তোমরা বড় হবার চেষ্টা করো। অনেক বড়, যাতে সারা দেশের মানুষ তোমাদের জন্মদিনের উৎসব করে। বাবা-মার করতে না হয়।
শেফু বলল সে প্রাণপণ চেষ্টা করবে বড় হবার।
আমি দেখলাম সুযোগ ফসকে যাচ্ছে। শুধু শেফুর জন্মদিন হবে আমার হবে, এ কেমন কথা! আমি গম্ভীর গলায় বললাম, বাবা, আমিও খুব বড় হবার চেষ্টা করব। আমারও জন্মদিন করতে হবে। বাবা বললেন, আচ্ছা তোমারও হবে।
শুধু ইকবাল ঘোষণা করল সে বড় হতে চায় না। ছোটই থাকতে চায়। তার জন্মদিন লাগবে না।
আমরা গভীর আগ্রহে অপেক্ষা করছি। নভেম্বরের ৯ তারিখ শেযুর জন্মদিন। দেখতে দেখতে ৯ তারিখ এসে পড়ল। আমরা খুব উদ্বিগ্ন হয়ে লক্ষ্য করলাম, এই উপলক্ষে কাউকে বলা হল না। বাবা বললেন, আমরা নিজেরা নিজেরা উৎসব করব। কাউকে বলব না।
পায়েস ছাড়া অন্য কোনো খাদ্যদ্রব্য তৈরি হল না। আমাদের মন ভেঙে গেল। সন্ধ্যার পর জন্মদিনের উৎসব শুরু হল। বাবা বীরপুরুষ কবিতা আবৃত্তি করলেন। প্রাণেশ কাকু তিনটা গান গাইলেন। পায়েস খাওয়া হল। তারপর বাবা ছোট্ট একটা বক্তৃতা দিয়ে শেফুর হাতে একটা উপহারের প্যাকেট তুলে দিলেন। সেই উপহার দেখে আমাদের সবার বিস্ময়ে বাবোধ হয়ে গেল। আমার দরিদ্র বাবা খুবই দামি উপহার কিনেছেন। চীনেমাটির চমৎকার খেলনা টি সেট, যা দেখলে একালের শিশুদেরও চোখ কপালে উঠে যাবার কথা।
বাবা বললেন,পছন্দ হয়েছে মা?
শেফু কাঁদতে কাঁদতে বলল, এত সুন্দর জিনিস সে তার জীবনে দেখেনি। আনন্দে সারারাত সে ঘুমাতে পারল না। বারবার বিছানা থেকে উঠে গিয়ে দেখে আসে টি সেট ঠিকঠাক আছে কি না। সেই রাতে আমি নিজেও উদ্বেগে ঘুমুতে পারলাম না। আর মাত্র তিন দিন পর আমার জন্মদিন। নাজানি কী অপেক্ষা করছে আমার জন্যে! গোপনসূত্রে খবর পেলাম, আমার জন্যে দশগুণ ভালো উপহার অপেক্ষা করছে। খবর দিলেন মা। মার খবর খুবই নির্ভরযোগ্য।
জন্মদিন এসে গেল। গান, কবিতা আবৃত্তির পালা শেষ হবার পর আমার হাতে উপহারের প্যাকেট তুলে দেয়া হল। প্যাকেট খুলে দেখি একটা বাঁধানো ফ্রেমে দীর্ঘ একটি কবিতা। বাবা ছেলের জন্মদিন উপলক্ষে একটি কবিতা লিখে ফ্রেমে বাঁধিয়ে নিয়ে এসেছেন। কবিতার প্রথম দুটি চরণ
সাতটি বছর গেল পরপর আজিকে পরেছে আটে,
তব জন্মদিন নয়ত মলিন ভয়াল বিশ্ব হাটে…
বাবা খুবই আগ্রহ নিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, কী রে, উপহার পছন্দ হয়েছে। অনেক কষ্টে কান্না চাপা দিয়ে বললাম, হ্যাঁ।
তোর মুখ দেখে মনে হচ্ছে পছন্দ হয় নাই।
আমি চুপ করে রইলাম।
বাবা খানিকক্ষণ শান্ত চোখে আমার দিকে তাকিয়ে থেকে বললেন, এই উপহার এখন তোর কাছে সামান্য মনে হচ্ছে। এমন একদিন আসবে যখন আর সামান্য মনে হবে না।
বাবা কবি ছিলেন না। হৃদয়ের তীব্র আবেগ-প্রকাশের মাধ্যম হিসেবে তিনি কবিতার আশ্রয় নিয়েছেন। তাঁর অতি আদরের ছোট বোনের মৃত্যুর খবর পাবার পর তিনি কাঁদতে কাঁদতে কবিতা লিখতে বসেছেন। চোখের জলে লেখা দীর্ঘ কবিতা হয়তো শুদ্ধতম কবিতা হয়নি। কিন্তু যে-আবেগের তাড়নায় কলম, নিয়েছিলেন সেই আবেগে কোনো খাদ ছিল না। বাবার কাছ থেকে প্রথম শিখলাম, মনে তীব্র ব্যথা কমানোর একটি উপায় হচ্ছে কিছু লেখা, যে-লেখা ব্যক্তিগত দুঃখকে ছড়িয়ে দেয় চারদিকে।
বাবা হচ্ছেন আমার দেখা প্রথম কবি।
আমার দেখা দ্বিতীয় কবি হচ্ছেন আমাদের বড়মামা ফজলুল করিম। তিনিও আমাদের বাসায় থাকতেন এবং এম. বি. কলেজে আই. এ. পড়তেন। আমার মেজো চাচা যেমন প্রতি বছর পরীক্ষা দিয়ে ফেল করতেন, বড়মামা ফেল। করতেন পরীক্ষা না দিয়ে। পরীক্ষা না দেবার চমৎকার সব যুক্তি বের করতেন। এইসব যুক্তিতে অতি সহজেই মাকে কাবু করে ফেলতেন।
পরীক্ষার আগের দিন মুখ গম্ভীর করে বলতেন, বুবু, এই বছরও পরীক্ষা দেব। বলে সিদ্ধান্ত নিয়েছি।
কেন? এই বছর আবার কী হল?
গত বৎসর পাশের হার বেশি ছিল, কাজেই এই বৎসর কম হবে। পরীক্ষা দিলে ফেল করতে হবে। আগামী বৎসর চেষ্টা চালাব ইনশাল্লাহ।
এই বৎসর পরীক্ষাটা দে, পাশ-ফেল পরের ব্যাপার।
আরে না! পরীক্ষা দিয়ে এনার্জি লস করার কোনো মানে হয় না।
বলাই বাহুল্য, পরের বৎসর তিনি পরীক্ষা দেন না। কারণ রুটিন খুব খারাপ হয়েছে। গ্যাপ কম। তবুও দিতেন, কিন্তু এনার্জি লসের ভয়ে দিচ্ছেন না। বড়মামা সব এনার্জি জমা করে রাখলেন এবং শুভক্ষণে পুরো এনার্জি নিয়ে জনৈকা তরুণীর প্রেমে পড়ে গেলেন। প্রেমের আবেগে কবিতার পর কবিতা বের হতে লাগল। আমার উপর দায়িত্ব পড়ল এইসব কবিতা যথাস্থানে পৌঁছে দেবার। আমি অত্যন্ত নিষ্ঠার সঙ্গে সেই দায়িত্ব পালন করে যেতে লাগলাম।
তরুণীর বিয়ে হয়ে যাওয়ায় প্রেমে ভাটার টান ধরল। গোটা পঞ্চাশেক বিরহের কবিতা লিখে বড়মামা হৃদয়যাতনা কমালেন। মজার ব্যাপার হচ্ছে, বড়মামার সেইসব কবিতা কিন্তু বেশ ভালো ছিল বলে আমার ধারণা। তিনি এইসব কবিতা প্রকাশ করার ব্যাপারে কোনোরকম আগ্রহ দেখাননি কিংবা পরবর্তী সময়ে কবিতা লেখার চেষ্টাও করেননি। তার ভাবটা এরকম, এইসব কবিতা তিনি শুধু দুজনের জন্যেই লিখেছেন—তৃতীয় কারওর জন্যে নয়।