মিষ্টি পানের একটা দোকান ছিল, তার সামনে খানিকক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকলেই দোকানি ছোট একটা পান বানিয়ে আমার হাতে দিয়ে বলত, ভাগ। কী সুস্বাদু ছিল সেই মিষ্টি পান!
গভীর আগ্রহে অপেক্ষা করতাম দেশের বাড়ির মেহমানদের জন্যে। মেহমান আসা মানেই আনন্দ। শহর দেখানোর জন্যে আমি চমৎকার গাইড। একদিন-না-একদিন তারা রঙমহল সিনেমা হলে ছবি দেখতে যাবেন। আমাকে সঙ্গে নিতেই হবে। আমাকে নেয়ার ব্যাপারে তারা তেমন আপত্তিও করবেন না। কারণ আমার জন্যে আলাদা করে টিকিট করতে হবে না। আমি ছবি দেখব কোলে বসে, কিংবা পঁড়িয়ে। বাড়িতে মেহমান থাকার আরেকটি বড় সুবিধা হচ্ছে সেই সময় মার শাসনব্যবস্থা দুর্বল হয়ে যেত। বড় ধরনের অপরাধেও মা কঠিন চোখে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকার শাস্তি ছাড়া অন্য শাস্তি দিতেন না।
মেহমানদের মধ্যে একজনের কথা আমার স্মৃতিতে উজ্জ্বল হয়ে আছে। তিনি মায়ের দিকের দূর-সম্পর্কের আত্মীয়। ভাটিঅঞ্চলের মানুষ। খুনের দায়ে হাজতে আছেন। জামিনে ছাড়া পেয়ে কয়েকদিন থাকতে এলেন আমাদের এখানে। অসম্ভব রকমের রুগ্ণ একজন মানুষ। যক্ষ্মা নামের কালরাত, সারাক্ষণ কাশছেন। কাশির সঙ্গে টাটকা রক্ত পড়ছে।
তিনি বাসায় এসেই মাকে ডেকে বললেন, রাজরোগে ধরেছে গো মা। এই ব্যাধি ছোঁয়াচে। তোমার ছেলেপুলের সংসার। ভেবেচিন্তে বলো আমাকে রাখবে? তিন-চার দিন থাকতে হবে। হোটেলে থাকতে পারি, কিন্ত হোটে থাকতে ইচ্ছা করছে না। তুমি ভেবেচিন্তে বলো।
মা বললেন, আপনি অবশ্যই আমার এখানে থাকবেন।
খুব ভালো কথা। তা-ই থাকব। বেশিদিন বাঁচব না। যে-কয়টা দিন আছি পরিচিত মানুষদের মধ্যে থাকতে চাই। তবে মা আমি যে থাকব, আমার কিছু শর্ত আছে।
কী শর্ত?
নিজের মতো বাজার-সদাই করব। এর জন্যে মনে কষ্ট নিও না। আমার অনেক জিনিসের অভাব আছে, টাকাপয়সার অভাব নাই। কী মা, রাজি?
মাকে রাজি হতে হল। আমরা পরম বিস্ময়ে দেখলাম—মাত্র চারদিন যে লোকটি থাকবে তার জন্যে বস্তাভরতি পোলায়ের চা আসছে, টিনভরতি ঘি, চিনি। দুপুরে প্রকাণ্ড একটা চিতলমাছ চলে এল, আঁকাভরতি মুরগি।
তিনি নিজে এতসব খাবারদাবারের কিছুই খেলেন না। মাকে বললেন, আমাকে তিন চামুচ আলোচালের ভাত আর এক চামুচ ঘি দিও। এর বেশি আমি কিছু খেতে পারি না। আল্লাহ আমার রিজিক তুলে নিয়েছেন।
শৈশবে যে অল্পকিছু মানুষ আমাকে প্রবলভাবে আকর্ষণ করেছিল উনি ছিলেন তাদের একজন। ভাটিঅঞ্চলের জমিদারবংশের মানুষ। এঁদের অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে স্থানীয় মানুষ একযোগে এঁদের বসতবাড়ি আক্রমণ করে। এঁরা তখন আত্মরক্ষার জন্যে কিংবা প্রতিহিংসা চরিতার্থ করার জন্যে বন্দুক নিয়ে দোতলা থেকে এলোপাতাড়ি গুলি করতে থাকেন। পঞ্চাশের মতো মানুষ আহত হয়, মারা যায় ছজন। জমিদারবাড়ির সকল পুরুষের বিরুদ্ধেই মামলা দায়ের করা হয়। পুলিশ আসামি হিসেবে সবাইকেই বেঁধে নিয়ে আসে। যক্ষ্মারোগে আক্রান্ত যে-মানুষটির কথা বলছি তিনিও আসামিদেরই একজন। পুলিশ এবং ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে স্বীকারোক্তিতে বলেছেন-বাড়ি যখন আক্রান্ত হয় তখন আমিই বন্দুক নিয়ে বের হই। আমি একাই গুলি করি-হত্যাকাণ্ডের সমস্ত দায়দায়িত্ব আমার। শাস্তি হলে আমার শাস্তি হবে। অন্য কারও নয়।
মজার ব্যাপার হল, হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে তার কোনোই যোগ ছিল না। এই ধরনের স্বীকারোক্তি তিনি করেছেন অন্যদের বাঁচাবার জন্যে। তাঁর যুক্তি হল—আমার যক্ষ্মা হয়েছে, আমি তো দুদিন পর এম্নিতেই মারা যাচ্ছি। ফাঁসিতেই নাহয় মরলাম। অন্যরা রক্ষা পাক। তা ছাড়া বাকি সবারই বৌ-ছেলেমেয়ে আছে। আমি চিরকুমার মানুষ, আমি বেঁচে থাকলেই কী, মরলেই কী?
যক্ষ্ম রুগির চোখ এম্নিতে উজ্জ্বল হয়। ওঁর চোখ আমার কাছে মনে হল ঝিকমিক করে জ্বলে। সারাক্ষণ ধবধবে সাদা বিছানায়, সাদা চাদর গায়ে জড়িয়ে মর্তির মতো বসে থাকেন। আমি বড়ই বিস্ময় অনুভব করি। একদিন হাত-ইশারা করে আমাকে ডাকলেন, আমি এগিয়ে যেতেই তীব্র গলায় বললেন, তুই সবসময় আমার আশেপাশে ঘুরঘুর করিস কেন? খবরদার, আর আসবি না। ছোট পুলাপান আমি পছন্দ করি না।
আহত ও অপমানিত হয়ে তার ঘর থেকে আমি বের হয়ে আসি, কিন্তু তাঁর প্রতি যে-গভীর ভালোবাসা লালন করি তার হেরফের হয়নি। মামলা চলাকালে জেল-হাজতে তাঁর মৃত্যু হয়। আমার মনে আছে, তাঁর মৃত্যুসংবাদ পেয়ে আমি বালিশে মুখ গুঁজে দীর্ঘ সময় কাঁদি।
সাহিত্য বাসর
বাবার অসংখ্য বাতিকের একটি হল-সাহিত্য-বাতিক। মাসে অন্তত দুবার বাসায় সাহিত্য বাসর নামে কী যেন হত। কী যেন হত বলছি এই কারণে যে, আমরা ছোটরা জানতাম না কী হত। আমাদের প্রবেশ নিষিদ্ধ ছিল। সাহিত্য চলাকালীন আমরা হৈচৈ করতে পারতাম না, উঁচু গলায় কথা বলতে পারতাম না, শব্দ করে হাসতেও পারতাম না। এর থেকে ধারণা হত, বসার ঘরে তারা যা করছেন তা খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
পর্দার আড়ালে দাঁড়িয়ে একদিন খানিকটা শুনলাম। আমার কাছে পুরো ব্যাপারটা হাস্যকর মনে হল। একজন খুব গম্ভীর মুখে একটা কবিতা পড়ল। অন্যরা তার চেয়েও গম্ভীর মুখে শুনল। তারপর কেউ বলল, ভালো হয়েছে, কেউ বলল মন্দ, এই নিয়ে তর্ক বেধে গেল। নিতান্তই ছেলেমানুষি ব্যাপার। একদিন একজনকে দেখলাম রাগ করে তার লেখা কুচি কুচি করে ছিড়ে ফেলে দ্রুত ঘর থেকে বের হয়ে গেল। অমি দুজন ছুটে গেল তাকে ধরে আনতে। ধরে আনা হল। বয়স্ক একজন মানুষ অথচ হাউমাউ করে কাঁদছে। কী অদ্ভুত কাণ্ড! কাণ্ড এখানে শেষ না। ছিড়ে কুচিকুচি করা কাগজ এরপর আঠা দিয়ে জোড়া লাগানো হতে লাগল। সেই লেখা পড়া হল, সবাই বলল, অসাধারণ। এই হচ্ছে বাবার প্রাণপ্রিয় সাহিত্য বাসর।