আমি কোনো কথা না বলে কাপড় পরলাম। কী হচ্ছে বুঝতে পারছি না। তিনি রিকশা করে আমাকে নিয়ে গেলেন কেন্দ্রীয় মুসলিম সাহিত্য সংসদে। বই এর এক বিশাল সংগ্রহ। যেদিকে চোখ যায় শুধু বই, বই আর বই। আমাকে লাইব্রেরির মেম্বার করে দিলেন। শান্ত গলায় বললেন, এখানে অনেক ছোটদের বই আছে, আগে এইগুলি পড়ে শেষ কর। তারপর বড়দের বই পড়বি।
প্রথমদিনের দুটি বই নিজে পছন্দ করে দিলেন। দুটি বইয়ের একটির নাম মনে আছে—টম কাকার কুটির। কী অপূর্ব বই! এই বইটি পড়বার আনন্দময় স্মৃতি এখনও চোখে ভাসে। ঝুমঝুম করে বৃষ্টি পড়ছে। সিলেটের বৃষ্টি—ঢালাও বর্ষণ। আমি কাঁথা মুড়ি দিয়ে বই নিয়ে বসেছি। টম কাকার গল্প পড়তে পড়তে চোখে নেমেছে অশ্রুর বন্যা। সমস্ত হৃদয় জুড়ে একধরনের শূন্যতা অনুভব করছি। হঠাৎ করে মহৎ সাহিত্যকর্মের মুখোমুখি হলে যা হয়, তা-ই হচ্ছে-প্রবল আবেগে চেতনা আলোড়িত হচ্ছে।
আমার বই পড়ার অভ্যাস মা খুব সহজভাবে গ্রহণ করতে পারলেন না। প্রায়ই বিরক্ত হয়ে বলেন, এই ছেলে দিনরাত আউট বই পড়ে। যখন সবাই খেলাধুলা করছে সে অন্ধকারে বই নিয়ে বসেছে। চোখ নষ্ট হবে তো!
চোখ আমার সত্যি সত্যি খারাপ হল। যদিও তা বুঝতে পারলাম না। বাইরের পৃথিবী আবছা দেখি। আমার ধারণা, অন্য সবাইও তা-ই দেখে। ক্লাস ফাইভে উঠে প্রথম চশমা নিই। চোখের ডাক্তার আমার চোখ পরীক্ষা করে আঁতকে উঠে বললেন, এই ছেলে তো অন্ধের কাছাকাছি! এতদিন সে চালিয়েছে কীভাবে? প্রথম চশমা পরে আমিও হতভম্ব হয়ে ভাবি-চারদিকের জগৎ এত স্পষ্ট! কী আশ্চর্য! দূরের জিনিসও তা হলে দেখা যায়!
আগের কথায় ফিরে আসি।
কেন্দ্রীয় মুসলিম সাহিত্য সংসদের সদস্য হওয়ায় সবচে কষ্টে পড়ল আমার ছোট দুই ভাইবোন-শেফু এবং ইকবাল। মীরাবাজার থেকে একা এতদূরে হেঁটে যেতে ভালো লাগে না। আমি এদের সঙ্গে নিয়ে যাই। পথ আর ফুরাতে চায় না। পথে দুতিন জায়গায় ক্লান্ত হয়ে বিশ্রাম করতে বসি। আমার সব ক্লান্তি সব কষ্ট দূর হয়ে যায় যখন দুটি বই হাতে পাই। আনন্দে ঝলমল করতে থাকি। শেফু এবং ইকবাল আমার এই আনন্দে অংশগ্রহণ করতে পারে না। শুধুমাত্র আমাকে সঙ্গ দেবার জন্যে তাদের দিনের পর দিন কষ্ট করতে হয়।
আমাকে রোজ দুটি করে বই দিতে গিয়ে একদিন লাইব্রেরিয়ানেরও ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে গেল। তিনি বিরক্ত গলায় বললেন, এখন থেকে একটি করে বই নেবে, দুটো না। আর এইসব আজেবাজে গল্পের বই পড়ে কোনো লাভ নেই। এখন থেকে পড়বে জ্ঞানের কথা, জ্ঞান-বিজ্ঞান, ইতিহাস, ভূগোল এইসব শিখতে হবে। নাও, আজকে এই বইটা নিয়ে যাও।
আমি খুব মন খারাপ করে বইটা হাতে নিলাম। বইয়ের নাম জানবার কথা। বাসায় এনে দুতিন পাতা পড়লাম। এতটুকুও আকর্ষণ করল না। পরদিন ফেরত দিতে গেছি। লাইব্রেরিয়ান ভদ্রলোক বললেন, পড়েছ?
আমি বললাম, হুঁ।
তিনি হাত থেকে বই নিয়ে কয়েকটা পাতা উলটে বললেন, আচ্ছা বলো, গ্লেসিয়ার কী?
আমি বলতে পারলাম না। তিনি দাঁত-মুখ খিঁচিয়ে বললেন, বদর ছেলে-যাও, এই বই ভালোমতো পড়ে তারপর আসো।
কেন্দ্রীয় মুসলিম সাহিত্য সংসদে আমি আর কখনো যাইনি। জানবার কথা বইটিও ফেরত দেয়া হয়নি। বাসায় ফিরে জানবার কথা কুটিকুটি করলাম, কিছুক্ষণ কাঁদলাম। আমি প্রচণ্ড অভিমানী হয়ে জন্মেছি। অভিমান নামক ব্যাপারটি কম নিয়ে জন্মানো ভালো। এই জিনিসটি আমাদের বড়ই কষ্ট দেয়।
বই পড়ার আগ্রহে সাময়িক ভাটা দেখা দিল। আগের জগতে ফিরে গেলাম-ঘুরে বেড়ানো। ইতিমধ্যে চুরিবিদ্যা খানিকটা রপ্ত হয়েছে। লক্ষ্য করেছি, মা ভাংতি পয়সা রাখেন তোশকের নিচে। সিকি, আধুলি, আনি দুআনি-ঠিক কত আছে, সেই হিসেব তার নেই। ভাংতি পয়সার মধ্যে সবচে ছোট হচ্ছে-সিকি। একবার একটা সিকি সরিয়ে সমস্ত দিন আতঙ্কে নীল হয়ে রইলাম। সারাক্ষণ মনে হল, এই বোধহয় মা বলবেন, সিকি কে নিয়েছে? মা তেমন কিছু করলেন না। পরদিন সেই সিকি নিয়ে এবং সঙ্গে ছোট বোনকে নিয়ে চায়ের স্টলে চা খেতে গেলাম। আমার উদ্দেশ্য হচ্ছে, বড়রা যেমন দোকানে চা খায়, আমরাও তেমনি খাব। দোকানদার নিশ্চয়ই দুই ক্ষুদে কাস্টমার পেয়ে বিস্মিত হয়েছিল। সে যত্ন করে আমাদের দুজনকে গ্লাসে করে দুকাপ চা দিল। একটা পরোটা ছিড়ে দুভাগ করে দুজনের হাতে দিল এবং কোনো পয়সা রাখল না। হাতের সিকি হাতেই রয়ে গেল। অতঃপর দুজনে একটা রিকশায় উঠে পড়লাম। কোনো গন্তব্য নেই-যতদূর রিকশা যায়। তখন রিকশাভাড়া ছিল বাধা। শহরের এক মাথা থেকে আরেক মাথা যাওয়া যেত এক সিকিতে। রিকশাওয়ালা আমাদের জল্লারপাড়ের কাছে নামিয়ে দিল। সেখান থেকে মহানন্দে হেঁটে বাসায় ফিরলাম। মনে হল, চুরিবিদ্যা খুব খারাপ কিছু নয়।
মার তোশকের নিচ থেকে প্রায়ই পয়সা উধাও হতে লাগল। একদিন কাজের ছেলে রফিক চুরির জন্যে প্রচণ্ড বকা খেল। তোশকের নিচে পয়সা রাখাও বন্ধ হয়ে গেল। বড় কষ্টে পড়লাম। এখন একমাত্র ভরসা দেশের বাড়ি থেকে বেড়াতে-আসা মেহমানরা।
আমাদের বাসায় মেহমান লেগেই থাকত। দাদার বাড়ির দিকের মেহমান, মার বাড়ির দিকের মেহমান। কেউ আসত শহর দেখতে, কেউ শাহজালাল সাহেবের মাজার দেখতে, কেউবা চিকিৎসা করাতে। মেহমানরা দয়াপরবশ হয়ে এক আনা বা দুপয়সা বাড়িয়ে দিতেন—পৃথিবীটাকে বড়ই সুন্দর মনে হত। ছুটে যেতাম দোকানে। কত অপূর্ব সব খাবার-হজমি! দুপয়সায় অনেকখানি পাওয়া যেত, টক টক ঝাঁঝালো স্বাদ। খানিকটা মুখে দিলেই জিভ কালো কুচকুচে হয়ে যেত। এক আনায় পাওয়া যেত দুগোল্লা সরষে তেল মাখানো বিচি-ছাড়ানো তেঁতুল। বাদামভাজা আছে, বুটভাজা আছে। যদুমিয়ার দোকানে পাওয়া যেত দুধ-চকলেট। এক আনায় চারটা, তবে আমার জন্যে একটা ফাউ। পাঁচটা।