আসল ব্যাপার হচ্ছে, খুব পুরানো কথা আমার কিছুই মনে নেই। তবে জন্মের চার বছরের পর থেকে অনেক কিছুই আমি মনে করতে পারি। সেইসব কথাই লিখব। শুরুটা করছি শোনা কথার উপর নির্ভর করে। শোনা কথার উপর নির্ভর করাও বেশ কঠিন। একই গল্প একেক জন দেখি একেক রকম করে বলেন। যেমন একজন বললেন, তোমার জন্মের সময় খুব ঝড়বৃষ্টি হচ্ছিল। অন্য একজন বললেন, কই না তো, প্রচণ্ড ঠাণ্ডা ছিল এইটা খেয়াল আছে, ঝড়বৃষ্টি তো ছিল না!
আমি সবার কথা শুনে শুনে একটি ছবি দাঁড় করিয়েছি। এই ছবি খানিকটা এদিক-ওদিক হতে পারে, তাতে কিছু যায় আসে না। আমি এমন কেউ না যে
আমার জন্মমুহূর্তের প্রতিটি ঘটনা হুবহু লিখতে হবে। কোনো ভুলচুক করা যাবে না। থাকুক কিছু ভুল। আমাদের জীবনের একটা বড় অংশ জুড়েই তো আছে ভুল এবং ভ্রান্তি।
আমার জন্ম ১৩ই নভেম্বর। ১৯৪৮ সন। শনিবার, রাত ১০টা তিরিশ মিনিট। শুনেছি ১৩ সংখ্যাটাই অশুভ। এই অশুভের সঙ্গে যুক্ত হল শনিবার। শনি মঙ্গলবারও নাকি অশুভ। রাতটাও কৃষ্ণপক্ষের। জন্মমুহূর্তে দপ করে হারিকেন নিভে গেল। ঘরে রাখা গামলার পানি উলটে গেল। একজন ডাক্তার, যিনি গত তিনদিন ধরে মার সঙ্গে আছেন, তিনি টর্চলাইট জ্বেলে তার আলো ফেললেন আমার মুখে। ক্ষিপ্ত গলায় বললেন, এই জানোয়ারটা দেখি তার মাকে মেরেই ফেলছিল!
আমি তখন গভীর বিস্ময়ে টর্চলাইটের ধাঁধানো আলোর দিকে তাকিয়ে আছি। চোখ বড় বড় করে দেখছি-এসব কী? অন্ধকার থেকে এ আমি কোথায় এলাম?
জন্মের পরপর কাঁদতে হয়। তাই নিয়ম।
চারপাশের রহস্যময় জগৎ দেখে কাঁদতেও ভুলে গেছি। ডাক্তার সাহেব আমাকে কাঁদাবার জন্য ঠাশ করে গালে চড় বসালেন। আমি জন্মমুহূর্তেই মানুষের হৃদয়হীনতার পরিচয় পেয়ে আকাশ ফাটিয়ে কাঁদতে লাগলাম। ঘরে উপস্থিত আমার নানিজান আনন্দিত স্বরে বললেন, বামুন রাশির ছেলে। বামুন রাশি বলার অর্থ প্রেসেন্টার সঙ্গে যুক্ত রক্তবাহী শিরাটি বামুনের পৈতার মতো আমার গলা পেঁচিয়ে আছে।
শিশুর কান্নার শব্দ আমার নানাজানের কানে যাওয়ামাত্র তিনি ছুটে এসে বললেন, ছেলে না মেয়ে?
ডাক্তার সাহেব রহস্য করবার জন্যে বললেন, মেয়ে, মেয়ে। ফুটফুটে মেয়ে।
নানাজান তৎক্ষণাৎ আধমণ মিষ্টি কিনতে লোক পাঠালেন। যখন জানলেন মেয়ে নয় ছেলে-তখন আবার লোক পাঠালেন-আধমণ নয়, এবার মিষ্টি আসবে একমণ। এই সমাজে পুরুষ এবং নারীর অবস্থান যে ভিন্ন তাও জন্মলগ্নেই জেনে গেলাম।
নভেম্বর মাসের দুর্দান্ত শীত।
গারো পাহাড় থেকে উড়ে আসছে অসম্ভব শীতল হাওয়া। মাটির মালশায় আগুন করে নানিজান সেক দিয়ে আমাকে গরম করার চেষ্টা করছেন।
আশেপাশের বৌ-ঝিরা একের পর এক আসছে এবং আমাকে দেখে মুগ্ধ গলায়
বলছে-সোনার পুতলা।
এতক্ষণ যা লিখলাম সবই শোনা কথা। মার কাছ থেকে শোনা। কিন্তু আমার কাছে খুব বিশ্বাসযোগ্য বলে মনে হয় না। কারণ আমি ঘোর কষ্ণবর্ণের মানুষ। আমাকে দেখে সোনার পুতলা বলে উচ্ছ্বাস প্রকাশ করার কিছু নেই। তা সদ জনামহুর্তের এতসব কথা আমার মারও মনে থাকার কথা নয়। তার তখন জীবন সংশয়। প্রসববেদনায় পুরো তিনদিন কাটা মুরগির মতো ছটফট করেছেন। অতিরিক্ত রকমের রক্তক্ষরণ হচ্ছে। পাড়াগার মতো জায়গায় তাকে বত দেবার কোনো ব্যবস্থা নেই। এই অবস্থাতেও তিনি লক্ষ্য করছেন, তার সোনার পাতলা গভীর বিস্ময়ে চারপাশের পৃথিবীকে দেখছে, কাঁদতে ভুলে গেছে, এটা বিশ্বাসযোগ্য নয়। আমার ধারণা, মা যা বলেছেন তা অন্যদের কাছ থেকে শুনেই বলেছেন।
ধরে নিচ্ছি, মা যা বলেছেন সবই সত্যি। ধরে নিচ্ছি, একসময় আমার গাত্রবর্ণ কাঁচা সোনার মতো ছিল। ধরে নিচ্ছি, আমার জন্মের আনন্দপ্রকাশের জন্য সেই রাতে একমণ মিষ্টি কিনে বিতরণ করা হয়েছিল। মিষ্টি কেনার অংশটি বিশ্বাসযোগ্য। নানাজানের অর্থবিত্ত তেমন ছিল না, কিন্তু তিনি দিলদরিয়া ধরনের মানুষ ছিলেন। আমার মা ছিলেন তাঁর সবচে আদরের প্রথমা কন্যা, বিয়ে হয়ে যাবার পরও যে-কন্যার মাথার চুল তিনি নিজে পরম যত্নে আঁচড়ে দিতেন। এই অতি আদরের কন্যার বিয়ের সময়ও তিনি জমিটমি বিক্রি করে খরচের চুড়ান্ত করলেন। পিতৃহৃদয়ের মমতা প্রকাশ করলেন দুহাত খুলে টাকা খরচের মাধ্যমে।
উদাহরণ দিই—মোহনগঞ্জ স্টেশন থেকে বর আসবে, হাঁটাপথে পাঁচ মিনিটের রাস্তা। পালকির ব্যবস্থা করলেই হয়। আমার নানাজান হাতির ব্যবস্থা করলেন। সুসং দুর্গাপুর থেকে দুটি হাতি আনানো হল। যে-লোেক এই কাজ করতে পারেন, তিনি তার প্রিয় কন্যার প্রথম সন্তানজন্মের খবরে বাজারের সমস্ত মিষ্টি কিনে ফেলতে পারেন।
আমার বাবা তখন সিলেটে। বিশ্বনাথ থানার ওসি।
ছেলে হবার খবর তাঁর কাছে পৌঁছল। তাঁর মুখ অন্ধকার হয়ে গেল। বেচারার খুব শখ ছিল প্রথম সন্তানটি হবে মেয়ে। তিনি মেয়ের নাম ঠিক করে বসে আছেন। একগাদা মেয়েদের ফ্রক বানিয়েছেন। রূপার মল বানিয়েছেন। তার মেয়ে মল পায়ে দিয়ে ঝমঝম করে হাঁটবে—তিনি মুগ্ধ হয়ে দেখবেন। ছেলে। হওয়ায় সব পরিকল্পনা মাঠে মারা গেল। তিনি একগাদা ফ্রক ও রূপার মল নিয়ে ছেলেকে দেখতে গেলেন। পাঠক-পাঠিকাদের জ্ঞাতার্থে জানাচ্ছি, এইসব মেয়েলি পোশাক আমাকে দীর্ঘদিন পরতে হয়। বাবাকে সন্তুষ্ট করার জন্যে মা আr, মাথার চুলও লম্বা রেখে দেন। সেই বেণিকরা চুলে রংবেরঙের রিবন পতে আমার শৈশবের শুরু।