সে সময় অধিকাংশ মেয়েই ছোট ভাইদের স্কুলে নিয়ে আসত। ছোট ভাইরা অনেক সময় অভিভাবকের মতো কাজ করত। বাবা-মারা নিশ্চিন্ত থাকতেন মেয়ের সঙ্গে পুরুষ-প্রতিভূ একজন-কেউ আছে। পারুল আপার সঙ্গে স্কুলে গিয়ে একবার বিরাট সমস্যায় পড়লাম। স্কুল কম্পাউন্ডের ভেতর একজন পাগল ঢুকে গেছে। মেয়েমহলে আতঙ্ক, ছোটাছুটি। আমি পারুল আপার নজর এড়িয়ে পাগল দেখতে গেলাম। কী আশ্চর্য, পাগল আমার চেনা! শুধু চেনা নয়, খুবই চেনা। উনি হচ্ছেন সুরসাগর প্রাণেশ দাস, বাবার ঘনিষ্ঠ বন্ধুদের একজন। প্রায়ই বাসায় আসেন। তখন গানের জলসা বসে। আমাদের বাসায় হারমোনিয়াম নেই, আমরা ছুটে গিয়ে লায়লা আপাদের বাসা থেকে হারমোনিয়াম নিয়ে আসি। ঘণ্টার পর ঘণ্টা তিনি গানবাজনা করেন। গায়ক প্রাণেশ দাস, শ্রোতা আমার বাবা। এইসব ওস্তাদি ধরনের গান আমাদের ভালো লাগে না, শুধু বাবা একাই আহা আহা করেন।
প্রাণেশ কাকু পাগল হয়ে গেছেন আমার জানা ছিল না। এখন অবাক হয়ে দেখি তিনি বিচিত্র ভঙ্গি করে মেয়েদের দিকে ছুটে ছুটে যাচ্ছেন। মেয়েরা দিগ্বিদিক–জ্ঞানশূন্য হয়ে ছুটছে। একে অন্যের উপর গড়িয়ে পড়ছে। আমি অসীম সাহসী। এগিয়ে গেলাম পাগলের দিকে। প্রাণেশ কাকু আমাকে চিনতে পারলেন। গম্ভীর গলায় বললেন, কী রে বাবু, ভালো?
আমি বললাম, জি ভালো। আপনি এরকম করছেন কেন?
প্রাণেশ কাকু লজ্জিত গলায় বললেন, মেয়েগুলিকে ভয় দেখাচ্ছি।
ভয় দেখাচ্ছেন কেন?
মেয়েগুলি বড় বজ্জাত। তোর বাবা ভালো আছেন।
জি।
হারমোনিয়াম কিনতে বলেছিলাম, কিনেছে।
জি না।
শখানেক টাকা হলে সিঙ্গেল রীড হারমোনিয়াম পাওয়া যায়। কিনে ফেললে হয়। রোজ-রোজ অন্যের বাসা থেকে আনা-তুই তোর বাবাকে বলবি।
জি আচ্ছা।
আর আমার মাথা যে খারাপ হয়ে গেছে এই খবরটাও দিস। বাড়িতে বেঁধে রাখে। তুই এখানে চুপচাপ দাঁড়া, আমি মেয়েগুলিকে আরেকটু ভয় দেখিয়ে আসি। তারপর তোকে নিয়ে তোদের বাসায় যাব।
জি আচ্ছা।
আমি চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইলাম। প্রাণেশ কাকু আরও কয়েকবার প্রচণ্ড হুংকার দিয়ে ফিরে এসে আমার হাত ধরে গেটের দিকে রওনা হলেন… তখনই হাতে লম্বা একটা লাঠি নিয়ে রণরঙ্গিণী মূর্তিতে আবির্ভূত হলে তা আপা। তাঁর মূর্তি প্রাণ–সংহারক। তিনি তীব্র গলায় বললেন, একে ছাড়েন। একে না ছাড়লে লাঠি দিয়ে এক বাড়িতে আপনার মাথা ফাটিয়ে দেব। ছাড়েন বলছি! পাগলের সিক্সথ সেন্স খুব ডেভেলপড হয় বলে আমার ধারণা। প্রাণেশ কাকু সঙ্গে সঙ্গে বুঝলেন, আমার হাত না ছাড়লে এই মেয়ে সত্যি সতি, ঘোট শরীরের সমস্ত শক্তি দিয়ে আঘাত করবে। তিনি আমার হাত ছেড়ে দিলেন। পারুল আপা ছুটে এসে ছোঁ মেরে আমাকে কোলে করে নিয়ে গেলেন, এত প্রবল উত্তেজনা সহ্য করার ক্ষমতা তার ছিল না–পারুল আপা হাত-পা এলিয়ে অজ্ঞান হয়ে পড়ে গেলেন।
পারুল আপা ছিলেন যাবতীয় নিষিদ্ধ বিষয়ে আমার জ্ঞানদাত্রী। পুরুষ এবং রমণীর ভেতর বাহ্যিক সম্পর্ক ছাড়াও যে অন্য একধরনের সম্পর্ক আছে তা প্রথম জানলাম তার কাছে। তখন আমার বয়স আট। ক্লাস থ্রীতে উঠেছি। জটিল সম্পর্কের বিষয় জানার জন্যে বয়সটা খুবই অল্প। খুবই হকচকিয়ে গেলাম-এসব কী বলছে পারুল আপা! কী অদ্ভুত কথা!
পারুল আপার কথা বিশ্বাস করার কোনোই কারণ দেখলাম না। কিন্তু উনিই-বা বানিয়ে বানিয়ে এমন অদ্ভুত কথা বলবেন কেন?
নরনারীর সম্পর্কের জটিলতা ব্যাখ্যা করার পেছনে পারুল আপার একটা কারণ ছিল। কারণ হচ্ছে, আমাদের পাশের বাসার ভদ্রলোক। ওঁদের বাড়িতে পনেরো-ষোলো বছরের সুন্দরমতো একটি কাজের মেয়ে ছিল। মেয়েটি ভদ্রলোককে বাবা ডাকত। হঠাৎ শুনি, তিনি এই মেয়েটিকে বিয়ে করেছেন। ভদ্রলোকের দুটি বড় মেয়ে কলেজে পড়ে। তারা খুব কান্নাকাটি করতে লাগল। ভদ্রলোকের স্ত্রী ঘনঘন ফিট হতে লাগলেন। ঘটনাটা চারপাশে বড় ধরনের আলোড়ন তৈরি করল। বড়রা সবাই এই ঘটনা নিয়ে আলাপ করে। সেই আলাপে আমি উপস্থিত হলে চোখ বড় বড় করে বলে-এই ভাগ!
কাজেই আমি নিজেই পারুল আপার কাছে জানতে চাইলাম ব্যাপারটা কী। তিনি গম্ভীর গলায় বললেন, বিয়ে না করে উপায় কী-ঐ মেয়ের পেটে বাচ্চা।
পেটে বাচ্চা হলে বিয়ে করতে হয় কেন?
তোকে বলা যাবে না। খুব লজ্জার কথা।
না, আমাকে বলতে হবে।
কাউকে বলবি না তো?
না, বলব না।
কসম খা।
কিসের কসম?
বল, বিদ্যা।
বিদ্যা।
বল, কোরান।
কোরান।
বল, টিকটিকি।
টিকটিকি বলব কেন? টিকটিকি আবার কীরকম কসম?
টিকটিকির যেমন লেঞ্জ খসে যায়-তুইও যদি এই কথা কাউকে বলিস তা হলে তোর জিভও খুলে পড়ে যাবে।
আমি ভয়ে ভয়ে টিকটিকির নামেও কসম করলাম—আর পারুল আপা গন্ধম ফলের সেই বিশেষ জ্ঞান আমাকে দিয়ে দিলেন। আমার মনে আছে, মনে খুব বড় ধরনের আঘাত পেলাম। চিৎকার করে বলতে ইচ্ছা হল, না, এসব মিথ্যা। এসব হতেই পারে না। ব্যাপারটা নিয়ে আমি যে কারও সঙ্গে আলাপ করব সেই উপায় নেই। টিকটিকির কসম খেয়েছি। জিহ্বা খুলে পড়ে যেতে পারে।
এই সময় পাশের বাড়ির ঐ ভদ্রলোকের বড় মেয়েটির হাসিরোগ হল। সারাক্ষণ হাসে। খিলখিল করে হাসে। গভীর রাতেও ঘুম ভেঙে শুনি পাশের বাড়ি থেকে হাসির শব্দ আসছে। গভীর রাতে সেই হাসি শুনে বড় ভয় লাগত। গা শিরশির করত। মেয়েটির কোথায় যেন বিয়ে ঠিক হয়েছিল-বাবার এই কাণ্ডে তার বিয়ে ভেঙে যাবার পরই হাসিরোগ হয়। তার কয়েকদিন পরই তারা বাড়ি ছেড়ে চলে যায়। ভদ্রলোকের স্ত্রীকে আমি নানু ডাকতাম। মেয়ে দুটিকে খালা। তারা আমাকে খুবই স্নেহ করত। প্রায়ই ডেকে নিয়ে বড়দের মতো কাপে করে চা খেতে দিত। দুনম্বর বোনটি আমাকে সবসময় জিজ্ঞেস করত—তার মতো সুন্দরী কোনো মেয়ে আমি দেখেছি কি না। এর উত্তরে আমি তৎক্ষণাৎ বলতাম, না।