দাদার বাড়ি প্রসঙ্গে অদ্ভুত একটা কথা বলি। দাদার বাবা জাঙ্গির মুনশির ইচ্ছামৃত্যু হয়েছিল। দাদাজানেরও ইচ্ছামৃত্যু হয়। মৃত্যুর সাতদিন আগে সবাইকে ডেকে তিনি তাঁর মৃত্যুর সময় বলেন, কেউ মনে কোনো আফসোস রাখবে না। মন শান্ত করো। আমাকে কেউ যদি বিশেষ কোনো সেবাযত্ন করতে চাও করতে পার।
দাদাজানের বলা সময়েই তাঁর মৃত্যু হয়। মৃত্যু হয় সজ্ঞানে। মৃত্যুর ঠিক আগের মুহূর্তে আমার ছোট চাচাকে ডেকে বলেন, আমি তা হলে যাই।
পৃথিবী বড়ই রহস্যময়।
দাদাজানদের বাড়িঘর অনেক পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন, ছিমছাম, গোছানো। মানুষগুলি হৈচৈ করে কম, কাজ করে বেশি। দাদার বাড়িতে আমাদের অবাধ স্বাধীনতা ছিল না। দাদাজান আমাদের চোখে-চোখে রাখতেন। আদব-কায়দা, ভদ্রতা শেখাতেন। সন্ধ্যাবেলা নামাজ শেষ করেই গল্প করতে বসতেন। সবই ঈশপের গল্পের মতো। গল্পের শেষে একটা মোরাল থাকত। মোরাল আছে এমন গল্প ভালো লাগার কথা নয়। কিন্তু দাদাজানের গল্প ভালো লাগত। মুগ্ধ হয়ে শুনতাম।
নানার বাড়ি থেকে দাদার বাড়িতে এলে শুরুতে খানিকটা দমবন্ধ দমবন্ধ লাগত। তবে দাদার বাড়িরও আলাদা মজা ছিল। বাড়ির বাংলাঘরে দুটি কাঠের আলমিরায় ছিল অসংখ্য বই। আসলে এই দুটি আলমিরা নিয়েই একটা পাবলিক লাইব্রেরি। আজিমুদ্দিন আহমেদ পাবলিক লাইব্রেরি। আজিমুদ্দিন আহমেদ আমার দাদার নাম। তার জীবদ্দশাতেই তাঁর নামে বাবা এই লাইব্রেরি করেন। লাইবেরির চাদা মাসে এক আনা। এই লাইব্রেরি থেকে কেউ কোনোদিন বই নিয়েছে বলে আমার জানা নেই। আমরা দাদার বাড়িতে উপস্থিত হলেই শুধু চাবি খুলে বই বের করা হত। চাবি চলে আসত আমার হাতে। দাদার বাড়িতে পুকুরপাড়ে বটগাছের মতো বিশাল এক কামরাঙা গাছ ছিল। সেই কামরাঙা গাছের গুড়িতে হেলান দিয়ে বই পড়ার আনন্দের কোনো তুলনা হয় না।
বাবা জায়গায় জায়গায় লোক পাঠিয়ে গ্রাম্য গায়কদের আনতেন। তারা তাদের বাদ্যযন্ত্র-হাতে উপস্থিত হতেন-রোগভোগা, অনাহারক্লিষ্ট মানুষ, কিন্তু তাদের চোখ বড়ই স্বপ্নময়।
দাদার বাড়িতে গানবাজনা হবার কোনো উপায় নেই। অনেকটা দূরে বাবার এক বন্ধুর বাড়ির উঠোনে গানের আসর বসত। হাত উঁচু করে যখন গাতক ঢেউ খেলানো সুরে, মাথার লম্বা বাবড়ি ঝাঁকিয়ে গানে টান দিতেন–
আমার মনে বড় দুষ্ক।
বড় দুঙ্ক আমার মনে গো।
তখন তার মনের দুষ্ক ছড়িয়ে যেত শ্রোতাদের মনে। চোখ ভরে জল আসত। গান চলত গভীর রাত পর্যন্ত। রাত যত গভীর হত গানে ততই আধ্যাত্মিক ভাব প্রাধান্য পেতে থাকত। শেষের দিকে সেগুলি আর গান থাকত না-হয়ে উঠত প্রার্থনা-সংগীত। আমরা ছোটরা অবিশ্যি তার আগেই ঘুমিয়ে পড়েছি। আমাদের কোলে করে বাড়িতে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। কিন্তু ঘুমের মধ্যে কোনো-এক অদ্ভুত উপায়ে গান শুনতে পাচ্ছি।
পারুল আপা
স্কুল আমার কাছে দুঃস্বপ্নের মতো ছিল। স্কুলের বাইরের জীবনটা ছিল আনন্দময়। সেই আনন্দের মাঝখানে দুঃস্বপ্নের মতোই উদয় হলেন পারুল আপা। লম্বা বিষাদময় চেহারার একটি মেয়ে। চোখ দুটি অস্বাভাবিক বড়। থাকেন আমাদের একটি বাসার পরের বাসায়।
তাঁর বাবা ওভারশিয়ার। রোগা একজন মানুষ। মাটির দিকে তাকিয়ে হাঁটেন। চিকন গলায় কথা বলেন। নিজের মেয়েদের অকারণ হিংস্র ভঙ্গিতে মারেন। সেই মার ভয়াবহ মার। যে-কোনো অপরাধে পারুল আপাদের দুবার শাস্তি হয়। প্রথমে বাবার হাতে, পরেরবার মায়ের হাতে। শাস্তির ভয়াবহতা সম্পর্কে একটা ধারণা দিই। পারুল আপা একবার একটা প্লেট ভেঙে ফেললেন, সেই প্লেট ভাঙার শাস্তি হল, চুলের মুঠি ধরে শূন্যে ঝুলিয়ে রাখা। পারুল আপা পরিবারের সবচেয়ে বড় মেয়ে। তারা অনেকগুলি বোন, কোনো ভাই নেই, নিয়ম করে প্রতি বছর পারুল আপাদের একটি করে বোন হয়। তার বাবা-মা দুজনেরই মুখ অন্ধকার হয়ে যায়।
যে-সময়ের কথা বলছি তখন পারুল আপার বয়স বারো-তেরো, বয়ঃসন্ধিকাল। বাবা-মার অত্যাচারে বেচারি জর্জরিত। তার মা তাকে ডাকেন হাবা নামে। অথচ তিনি মোটেই হাবা ছিলেন না। তার অসম্ভব বুদ্ধি ছিল। হৃদয় ছিল আবেগ ও ভালোবাসায় পরিপূর্ণ। কোনো-এক বিচিত্র কারণে তিনি তার হৃদয়ের সমস্ত আবেগ ও ভালোবাসা আমার উপর উজাড় করে দিলেন। যে-ভালোবাসা না চাইতেই পাওয়া যায়, তার প্রতি কোনো মোহ থাকে না। পারুল আপার ভালোবাসা আমার অসহ্য বোধ হত। অসহ্য বোধ হবার আরও একটি কারণ ছিল। তার চেহারা তেমন ভালো ছিল না। আমার চরিত্রের বড় রকমের দুর্বল দিকের একটি হচ্ছে, মেয়েদের দৈহিক রূপের প্রতি আমার তীব্র আকর্ষণ। যে দেখতে ভালো না, সে হাজারো ভালো হলেও আমার কাছে গ্রহণযোগ্য নয়। রূপবতীদের বেলায় আমি অন্ধ। তাদের কোনো ত্রুটি আমার চোখে পড়ে না। তাদের দৈহিক সৌন্দর্যই আমার সমগ্র চেতনাকে আচ্ছন্ন করে রাখে। বলতে ইচ্ছে করে, আমি তব মালঞ্চের হব মালাকর।
থাক সে কথা, পারুল আপার কথা বলি। তিনি ভালোবাসার কঠিন শিকলে আমাকে বাঁধতে চাইলেন। আমাকে ভুলানোর জন্যে তার সে কী চেষ্টা! বাবার পকেট থেকে পয়সা চুরি করে আমাকে দিতেন। স্কুলের টিফিনের জন্যে তাকে সামান্য পয়সা দেয়া হত। তিনি না খেয়ে সেই পয়সা জমিয়ে রাখতেন আমার জন্যে। এর প্রতিদানে মাঝে মাঝে তার সঙ্গে স্কুলে যেতে হত। সেটা অতি বিরক্তিকর ব্যাপার। তিনি ক্লাস করছেন, আমি বেজার মুখে তার পাশে বসে। তিনি একটা হাতে আমার গলা জড়িয়ে আছেন।