খ) মেঘের ডাক শুনে ঝাঁক বেঁধে কইমাছ পানি ছেড়ে ডাঙায় উঠে আসছে এবং প্রাণপণ চেষ্টা করছে শুকনো দিয়ে কোনো-এক গন্তব্যে যেতে। কেন তারা বর্ষার প্রথম মেঘগর্জনে এমন পাগল হয়, কে বলবে!
গ) ভূতে-পাওয়া রুগির চিকিৎসা করতেও দেখলাম। ভূতের ওঝা এসে রুগির সামনে ঘর কেটে সেই ঘরে সরিষা ছুঁড়ে ছুঁড়ে মারছে। রুগি যন্ত্রণায় ছটফট করতে করতে বলছে আর মারিস না। আর মারিস না।
ঘ) এক হিন্দুবাড়িতে নপুংসক শিশুর জন্ম হল। কোত্থেকে খবর পেয়ে একদল হিজড়া উপস্থিত। শুরু হল নাচানাচি। নাচানাচির এক পর্যায়ে এরা গা থেকে সব কাপড় খুলে ফেলল। ঝুড়ি ভরতি করে ডিম নিয়ে এসেছিল, সেইসব ডিম ছুঁড়ে মারতে লাগল বাড়িতে। একসময় শিশুটি তাদেরকে দিয়ে দেয়া হল। মহানন্দে তারা চলে যাচ্ছে। ব্যাকুল হয়ে কাঁদছে শিশুটির মা। হৃদয়ে রক্তক্ষরণ হয় এমন একটি দৃশ্য। আমার নিজের চোখে দেখা।
ঙ) এক সন্ধ্যায় নানার বাড়িতে ঢিল পড়লে লাগল। ছোট ছোট ঢিল নয়-ক্ষেত থেকে উঠিয়ে আনা বিশাল মাটির চাঙড়। নানিজান বললেন, কয়েকটা দুষ্ট জিন আছে। মাঝে মাঝে এরা উপদ্রব করে। তবে ভয়ের কিছু নাই, এইসব ঢিল কখনো গায়ে লাগে না।
ব্যাপারটা পরীক্ষা করবার জন্যে উঠোনে খানিকক্ষণ ছোটাছুটি করলাম। আশেপাশে ঢিল পড়ছে, গায়ে পড়ছে না—বেশ মজার ব্যাপার।
নিশ্চয় এর লৌকিক কোনো ব্যাখ্যা আছে। ব্যাখ্যা থাকলেও আমার জানা। নেই। জানতেও চাই না। নানার বাড়ির অনেক রহস্যময় ঘটনার সঙ্গে এটিও থাকুক। সব রহস্য ভেদ করে ফেলার প্রয়োজনই-বা কী?
এবার দাদার বাড়ি সম্পর্কে বলি।
দাদার বাড়ির এক বিশেষ পরিচিতি ঐ অঞ্চলে ছিল এবং খুব সম্ভব এখনও আছে-মৌলবিবাড়ি। এই বাড়ির নিয়মকানুন অন্যসব বাড়ি থেকে শুধ যে আলাদা তা-ই না-ভীষণ রকম আলাদা। মৌলবিবাড়ির মেয়েদের কেউ কোনোদিন দেখেনি, তাদের গলার স্বর পর্যন্ত শোনেনি। এই বাড়িতে গানবাজনা নিষিদ্ধ। আমরা দেখেছি, ভেতরের বাড়িতেও বড় বড় পর্দা। একই বাড়িতে পুরুষদেরও মেয়েদের সঙ্গে দূরত্ব রক্ষা করে চলতে হত। ভাবের আদানপ্রদান হাত ইশারায় কিংবা হাততালিতে। যেমন, পর্দার এপাশ থেকে দাদাজান একবার কালি দিলেন, তার মানে তিনি পানি চান। দুবার হাততালি-পান-সুপারি। তিনবার হাততালি-মেয়েদের গলার স্বর শোনা যাচ্ছে, আরও নিঃশব্দ হতে হবে।
আমাদের হল পিরবংশ। দাদার বাবা জাঙ্গির মুনশি ছিলেন এই অঞ্চলের পিরসাহেব। তাঁকে নিয়ে প্রচলিত অনেক গল্পগাথার একটি গল্প বলি? জাঙ্গির মুনশি তার মেয়ের বাড়িতে বেড়াতে গেছেন। সেই আমলে যানবাহন ছিল না। দশ মাইল পথ হেঁটে যেতে হল। দুপুরে পৌঁছলেন। মেয়ের বাড়িতে খাওয়াদাওয়া করে ফেরার পথে বললেন, মা, আমার পাঞ্জাবির একটা বোতাম খুলে গেছে। তুমি সুই-সুতা দিয়ে একটা বোতাম লাগিয়ে দাও। বোতাম ঘরে আছে তো?
মেয়ে বোতাম লাগিয়ে দিল। তিনি দশ মাইল হেঁটে বাড়ি ফিরলেন। বাড়িতে পা দেয়ামাত্র মনে হল, বিরাট ভুল হয়েছে। তার কন্যা যে বোতাম লাগাল সে কি স্বামীর অনুমতি নিয়েছে? স্বামীর বিনা অনুমতিতে স্বামীর সংসারের জিনিস ব্যবহার করা তো ঠিক না। তিনি আবার রওনা হলেন, অনুমতি নিয়ে আসা যাক। আবার কুড়ি মাইল হাঁটা।
অমি নিজে অবিশ্যি এই গল্প অন্যভাবে ব্যাখ্যা করি। আমার ধারণা, মেয়ের বাড়ি থেকে ফিরে এসে তার মন খুব খারাপ হয়ে গেল। আবার মেয়েকে দেখার ইচ্ছা হল। একটা অজুহাত তৈরি করে রওনা হলেন।
দাদার বাড়ির কঠিন সব অনুশাসনের নমুনা হিসেবে একটা গল্প বলি। আমার ফুফুরা খুব সুন্দরী। পির পরিবারের বংশধররা সচরাচর রূপবান হয়। তাঁরাও ব্যতিক্রম নন। দুজন ফুপুই পরীর মতো। বড় ফুপুর বিয়ের বয়স হলে বাবা তার জন্যে একজন ছেলে পছন্দ করলেন। ছেলে বাবার বন্ধু। ইংরেজি সাহিত্যে এম. এ.। ছেলেও অত্যন্ত রূপবান। বাবা তার বন্ধুকে সঙ্গে করে গ্রামের বাড়িতে এলেন। দাদাজানের ছেলে পছন্দ হল। মেয়ে দেখানো হল। কারণ ধমে নাকি বিধান আছে, বিয়ের আগে ছেলে মেয়েকে এবং মেয়ে ছেলেকে অন্তত একবার দেখতে পারবে। ছেলে মেয়ে দেখে মুগ্ধ। সেই রাতের কথা,-বাবা তার বন্ধুকে নিয়ে বেড়াতে বের হয়েছেন। খোলা প্রান্তরে বাবার বন্ধু গান ধরল। রবীন্দ্রনাথের গান তখন শিক্ষিতমহলে গাওয়া শুরু হয়েছে।
গানটি হল-আজি এ বসন্তে…..
গান গাওয়ার খবর দাদাজানের কানে পৌঁছল। তিনি বাবাকে ডেকে নিয়ে বললেন, এই ছেলে যে গান জানে তা তো তুমি বল নাই।
বাবা বললেন, হ্যাঁ, সে গান জানে।
এইখানে মেয়ে বিয়ে দিব না। তুমি জেনেশুনে গান-জানা ছেলে এবাড়ির আনলে কেন?
গান গাওয়া ক্ষতি কী?
লাভ-ক্ষতির ব্যাপার না! আমরা কয়েক পুরুষ ধরে যে-নিয়ম মানছি আমার জীবিত অবস্থায় তার কোনো ব্যতিক্রম হবে না। তুমি যদি রাগ কর আমার কিছুই বলার নাই। রাগ করে বাড়িতে আসা বন্ধ করলেও করতে পার।
দাদাজান তার মেয়েকে নিজে দেখেশুনে পৃথিবী থেকে দূরে সরে থাকা একটি পরিবারে বিয়ে দিয়ে দিলেন।
আমরা যখন দাদার বাড়িতে বেড়াতে যেতাম, খবর পেয়ে বড় ফুপু আসতেন পালকি করে। পালকি অনেক দূরে অপেক্ষা করত। ফুপুর স্বামী খোঁজ নিতে আসতেন—আমরা যে এসেছি আমাদের সঙ্গে কলের গন আছে কি না। যদি জানতেন কলের গান আছে-সঙ্গে সঙ্গে স্ত্রীকে নিয়ে ফিরে যেতেন।
ধীরে ধীরে দাদার বাড়ির মানসিকতার পরিবর্তন হয়। যে-গান এই বাড়িতে নিষিদ্ধ ছিল সেই গানও চালু হয়। দাদার নির্দেশেই হয়। আমার ছোট বোন শেফুর গলায়-তোরা দেখে যা আমিনা মায়ের কোলে গান শোনার পর দাদাজান নির্দেশ দেন—গান চলতে পারে।