অসাধারণ ব্যাপার একটা ঘটেছে—আমরা নানার বাড়ি এবং দাদার বাড়ি বেড়াতে যাচ্ছি। আমার শৈশবের সবচে আনন্দময় সময় হচ্ছে এই দুজায়গায় বেড়াতে যাওয়া। প্রতি দুবছর পরপর একবার তা ঘটত। আমার মনে হত, এত আনন্দ এত উত্তেজনা সহ্য করতে পারব না। অজ্ঞান হয়ে যাব। আমরা দুটিতে যাচ্ছি। ছুটিতে যাচ্ছি। ছুটিতে যাচ্ছি।
ছুটি!
সিলেট মেলে রাতে চড়ব। গভীর রাতে সেই ট্রেন ভৈরবের ব্রিজে উঠবে। আমরা যদি ঘুমিয়ে পড়ি আমাদের ডেকে তোলা হবে। গভীর বিস্ময়ে দেখব ভৈরবের ব্রিজ। ভোরবেলায় ট্রেন পৌঁছবে গৌরীপুর জংশন। ঘুম ভাঙবে চাওয়ালাদের অদ্ভুত গলা চা-গ্রাম চা-গ্রাম শব্দে। মিষ্টি লুচি দিয়ে সকালের নাশতা। চার থেকে পাঁচ ঘণ্টা গৌরীপুর জংশনে যাত্রাবিরতি। কী আনন্দ! কী আনন্দ! স্টেশনের এক মাথা থেকে অন্য মাথায় ঘুরে বেড়াও। ওভারব্রিজে উঠে তাকিয়ে দ্যাখো পিপীলিকার সারির মতো ট্রেনের সারি। দূরের দিগন্তে বিস্তৃত ধানের ক্ষেত। সেই ক্ষেতে নেমেছে সাদা বকের দল। তারা উড়ে উড়ে যায় আবার এসে বসছে। আরও অনেক দূরে মেঘের কোলে নীলরঙা গারো পাহাড়। এইগুলি কি এই পৃথিবীর দৃশ্য? না, এই পৃথিবীর দৃশ্য নয়–ধুলোমাটির এই পৃথিবী এত সুন্দর হতে পারে?
নানার বাড়ি পৌঁছতে পৌঁছতে নিশুতিরাত। কিন্তু স্টেশন গমগম করছে। নানার বাড়ির এবং তাদের আশেপাশের বাড়ির সব পুরুষ চলে এসেছেন। মহিলারাও এসেছেন। তাঁরা স্টেশনে ঢোকেননি, একটু দূরে হিন্দুবাড়িতে দাঁড়িয়ে আছেন।
দরজা দিয়ে নামার সুযোগ নেই। তার আগেই আমাকে কেউ হাত বাড়িয়ে জানালা দিয়ে কোলে তুলে নিয়েছেন। একজনের কোল থেকে আরেকজনের কোলে ঘুরছি। মা খুশিতে ক্রমাগত কাঁদছেন। আহা কী আনন্দময় দৃশ্য!
দুটি হ্যাজাকবাতিতে রাস্তা আলো করে আমরা রওনা হলাম। দুপাশে অন্ধকার–করা গাছপালায় রাজ্যের জোনাকি জ্বলছে, নিভছে। ঐ তো দেখা যাচ্ছে কালীবাড়ি। মা কালী জিভ বের করে শিবের বুকে পা দিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন, নানার বাড়ি পৌঁছতে তা হলে দেরি নেই। অসংখ্য শিয়াল একসঙ্গে ডাকছে-রাত্রির প্রথম প্রহর শেষ হল বোধহয়।
একবার বলেছি, আবার বলি, আমার জীবনের সবচে আনন্দময় সময় কেটেছে নানার বাড়িতে। বাড়িটার তিনটা ভাগ-মূল বসতবাড়ি, মাঝের ঘর, বাংলাঘর।
বাংলাঘরের সামনে প্রকাণ্ড খাল। বর্ষায় সেই খাল কানায়-কানায় ভরা থাকে। ঘাটে বাঁধা থাকে নৌকা। কাউকে বললেই নৌকা নিয়ে খানিকটা ঘুরিয়ে আনে।
মূল বাড়ির পেছনে ঘন জঙ্গল। এমনই ঘন যে গাছের পাতা ভেদ করে আলো আসে না। সেই জঙ্গলের ভেতর সার দেয়াল। সার দেয়াল হল পাঁচিল দিয়ে ঘেরা নানাদের শক্তিমান পূর্বপুরুষদের কবরস্থান। জঙ্গলে কত বিচিত্র ফলের গাছ-লটকান, ডেউয়া, কামরাঙা…..।
চারপাশে কত বিচিত্র চরিত্রের মানুষ। আমাদের মন-ভুলানোর জন্যে সবার সে কী চেষ্টা। আমার এক মামা (নজরুল মামা) কোত্থেকে ভাড়া করে ধোপাদের এক গাধা নিয়ে এলেন। গাধা যে আসলেই গাধা সেটা বোঝা গেল-সাত চড়ে রা নেই। পিঠে চড়ে বসো, পিঠ থেকে নামো-কিছু বলবে না। শুধু পেছনের দিকে যাওয়া নিষেধ। হঠাৎ লাথি বসাতে পারে।
বাচ্চাদের আনন্দ দেয়ার জন্যে ঘুড়ি উড়ানো হবে। সেই ঘুড়ি নৌকার পালের চেয়েও বড়। একবার আকাশে উঠলে প্লেনের মতো আওয়াজ হতে থাকে। ঘড়ি বেঁধে রাখতে হয় গাছের সঙ্গে, নয়তো উড়িয়ে নিয়ে চলে যাবে।
সন্ধ্যাবেলা লাটিম খেলা। প্রকাও এক লাটিম। লাটিম ঘোরানোর জন্যে লোক লাগে দুজন। লাটিম ঘুরতে থাকে ভোঁ-ভো আওয়াজে। আওয়াজে কানে তালা ধরে যায়।
একটু রাত বাড়লে ফাডার টার (পাঁঠার টক্কর)। দুটি হিংস্র ধরনের বাঁকা শিংয়ের পাঁঠার মধ্যে যুদ্ধ। দুপ্রান্ত থেকে এরা ঘাড় বাঁকিয়ে ছুটে আসবে। প্রচণ্ড শব্দে একজনের শিং-এ অন্যজন আঘাত করবে। আগুনের ফুলকি বের হবে শিং থেকে। শুরু হবে মরণপণ যুদ্ধ, ভয়াবহ দৃশ্য।
মামাদের কেউ গভীর রাতে আমাদের ঘুম থেকে ডেকে তুলবেন। তারা আউল্লা দিতে যাচ্ছেন। সঙ্গে যাব কি না। ব্যাপারটা হল আলো দিয়ে মাছ মারা। অল্প পানিতে হ্যাজাকের তীব্র আলো ফেলা হয়। সেই আলোয় দেখা যায় শিং, মাগুর শুয়ে আছে। আলোতে এদের চোখ ধাধিয়ে যায়-নড়তে চড়তে পারে না। তখন থোর দিয়ে তাদের গেঁথে ফেলা হয়।
খুব ভোরে নানাজানের সঙ্গে ভ্রমণ। নানাজানের হাতে দুনলা বন্দুক। তিনি যাচ্ছেন বিলের দিকে, আমরা পেছনে পেছনে আছি। ছররা গুলিতে তিন-চারটা বক একসঙ্গে মারা পড়ল। মৃত পাখিদের ঝুলিয়ে আমরা এগুচ্ছিনাকে আসছে মাটির গন্ধ, মৃত পাখিদের রক্তের গন্ধ, বারুদের গন্ধ।
সারাদিন পুকুরে ঝাঁপাঝাঁপি, নিশুতিরাতে ঘুম ভেঙে টিনের চালে বৃষ্টির শব্দ শোনা-এই আনন্দের যেমন শুরু নেই তেমনি, শেষও নেই। হোটদের শোবার ব্যবস্থা মাঝের ঘরে। ঢালাও বিছানা। বিছানার একপ্রান্তে মা বসে আছেন, পরিচিতজনরা আসছে। গল্প হচ্ছে, পান খাওয়া হচ্ছে, রাত বাড়ছে। কী চমৎকার সব রাত!
নানার বাড়ি ঘিরে আমার অদ্ভুত সব স্মৃতি। মাঝে মাঝে স্বপ্নদৃশ্যের মতো এরা উঠে আসে। জীবনের সঙ্গে মেলাতে পারি না। কয়েকটি স্মৃতি উল্লেখ করছি।
ক) সাপে-কাটা রুগিকে ওঝা চিকিৎসা করছে-এই দৃশ্য নানার বাড়িতেই প্রথম দেখি। রুগি জলচৌকিতে বসে আসে, ওঝা মন্ত্র পড়তে পড়তে হাত ঘোরাচ্ছে। সেই ঘুরন্ত হাত অতি দ্রুত নেমে আসছে রুগির গায়ে। চিকিৎসা শেষ পর্যায়ে কাঁইক্যা মাছের কাঁটা দিয়ে রুগির পা থেকে দৃষিত রক্ত বের হচ্ছে।