আমি বললাম, হুঁ। স্যার বলেছেন, পাকিস্তানের সব স্কুলের ছাত্রছাত্রীদের দুই টিন করে দিয়েছে। মা অবাক বিস্ময়ে বললেন, একটা দেশ কত ধনী হলে এমন সাহায্য দিতে পারে! মা আমেরিকার প্রতি বড়ই কৃতজ্ঞ হলেন। আমরা সকালের নাশতায় রুটি-মাখন খেতে শুরু করলাম।
টিন দুটি শেষ হবার আগেই দ্বিতীয় দফায় আবার পাওয়া গেল। এবং জানা গেল প্রতি মাসে দুবার করে দেয়া হবে। স্কুলের হেডমাস্টার সাহেবের ঘর দুধ এবং মাখনের টিনে ভরতি হয়ে গেল। মার মুখের হাসি আরও বিস্তৃত হল। আমেরিকা নামের সোনার দেশের সুখ ও সমৃদ্ধি কামনা করে তিনি সম্ভবত শোকরানা নামাজও আদায় করলেন।
যদিও হেডস্যারের ঘর ভরতি ছিল দুধ এবং মাখনের টিনে, আমরা আর পেলাম না। হেডমাস্টার সাহেব ঠিক করলেন, ছাত্রদের স্কুলেই দুধ বানিয়ে খাওয়ানো হবে। দুধ বানানোর আনুষঙ্গিক খরচ আছে। চুলা কিনতে হবে, ছাত্রদের জন্যে মগ কিনতে হবে, জ্বালানির খরচ আছে। এইসব খরচ মেটানো হবে মাখনের টিন বিক্রি করে।
দুই-তিনদিন তা-ই হল। বিশাল কড়াইয়ে দুধ জ্বাল দেয়া হল। অতি অখাদ্য সেই দুধ জোর করে আমাদের খাওয়ানো হল। শারীরিক শাস্তির চেয়েও সেই শান্তি ভয়াবহ ছিল। আমরা প্রতিটি ছাত্রছাত্রী মনেপ্রাণে প্রার্থনা করলাম, আল্লাহ, তুমি আমাদের এই দুধের হাত থেকে বাঁচাও!
আল্লাহ শিশুদের প্রার্থনা শুনলেন। শাস্তি বন্ধ হল। দুধ খাওয়ানো শেষ হল। আমাদের শিক্ষকরা সবাই রিকশা ভরতি করে দুধ ও মাখনের টিন বাড়ি নিয়ে গেলেন। আমার বয়স তখন খুবই কম। এই বয়সে দুর্নীতি সম্পর্কে কোনো ধারণা হবার কথা নয়, কিন্তু আমাদের সম্মানিত শিক্ষকরাই সেই ধারণা আমাদের মাথায় ঢুকিয়ে দিলেন। আমার জীবনে শিক্ষকেরা এসেছেন দুষ্টগ্রহের মতো আমি সারাজীবনে অনেক কিছু হতে চেয়েছি–আইসক্রিমওয়াল, পালিশওয়ালা থেকে ডাক্তার, ব্যারিস্টার—কিন্তু কখনো শিক্ষক হতে চাইনি। বলেই বোধহয় এখন জীবন কাটাচ্ছি শিক্ষকতায়।
মাথামোটা শংকর এবং গ্রীন বয়েজ ফুটবল ক্লাব
থ্রী থেকে ফোরে উঠব।
বার্ষিক পরীক্ষা এসে গেছে। বাড়িতে বাড়িতে পড়াশোনার ধুম। আমি নির্বিকার। বই নিয়ে বসতে ভালো লাগে না, যদিও পড়তে বসতে হয়। সেই বসাটা পুরোপুরিই ভান। সবাই দেখল, আমি বই নিয়ে বসে আছি, এই পর্যন্তই। তখন প্রতি সন্ধ্যায় সিলেট শহরে মজাদার ব্যাপার হত-তার নাম লেমটন লেচকার। কথাটা বোধহয় লণ্ঠন লেকচার-এর বিকৃত রূপ। ভ্রাম্যমাণ গাড়িতে করে জায়গায় জায়গায় সিনেমা দেখানো। পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা ম্যালেরিয়া এইসব ভালো ভালো জিনিস। আমাদের কাজের ছেলে রফিক খোঁজ নিয়ে আসে আজ কোথায় লেমটন লেচকার হচ্ছে—মুহূর্তে আমরা দুজন হাওয়া। রফিক তখন আমার বন্ধুস্থানীয়। তার কাছ থেকে বিড়ি খাওয়ার উপর কোর্স নিচ্ছি। বিড়ি খেলে কচি পেয়ারা পাতা চিবিয়ে মুখের গন্ধ নষ্ট করতে হয় এসব গুহ্যবিদ্যা শিখে নিচ্ছি। এই জাতীয় শিক্ষায় আমার আগ্রহের কোনো অভাব দেখা যাচ্ছে না।
লেমটন লেকচারের ভূত আমার ঘাড় থেকে নামানোর অনেক চেষ্টা করা হল। নামানো গেল না। মা হাল ছেড়ে দিলেন। এখন আর সন্ধ্যা হলে পড়তে বসতেও বলেন না। আমি মোটামুটি সুখে আছি বলা চলে।
এমন এক সুখের সময়ে মাথামোটা শংকর খুব উত্তেজিত ভঙ্গিতে বলল, তার মা তাকে বলেছেন সে যদি ক্লাস থ্রী থেকে পাশ করে ফোর-এ উঠতে পারে তা হলে তাকে ফুটবল কিনে দেবেন।
সে আমার কাছে এসেছে সাহায্যের জন্য, কী করে এক ধাক্কায় পরের ক্লাসে ওঠা যায়। একটা চামড়ার ফুটবলের আমাদের খুবই শখ। সেই ফুটবল এখন মনে হচ্ছে খুব দূরের ব্যাপার নয়। সেইদিনই পরম উৎসাহে শংকরকে পড়াতে বসলাম। যে করেই হোক তাকে পাশ করাতে হবে। দুজন একই ক্লাসে পড়ি। এখন সে ছাত্র, আমি শিক্ষক। ওকে পড়ানোর জন্যে নিজেকে প্রথম পড়তে হয়, বুঝতে হয়। যা পড়াই কি করে মাথায় ঢোকে না। মনে হয় তার দুই কানে রিফ্লেক্টর লাগানো। যা বলা হয় সেই রিফ্লেক্টরে ধাক্কা খেয়ে ফিরে আসে, ভেতরে ঢুকতে পারে না। যাই হোক প্রাণপণ পরিশ্রমে ছাত্র তৈরী হল। দুজন পরীক্ষা দিলাম। ফল বের হলে দেখা গেল আমার ছাত্র ফেল করেছে এবং আমি মকুলের সমস্ত শিক্ষকদের স্তম্ভিত করে প্রথম হয়ে গেছি। ফুটবল পাওয়া যাবে না এই দুঃখে রিপোর্ট কার্ড হাতে কাঁদতে কাঁদতে বাসায় ফিরলাম।
এই রুদ্র ঘটনা বাবাকে খুব মুগ্ধ করল। বাসায় যে-ই আসে বলেন, আমার ছেলের কাণ্ড শুনুন। পরীক্ষায় ফার্স্ট হয়ে কাঁদতে কাঁদতে বাসায় ফিরেছে। কারণ হল…চ
এই ঘটনার আরেকটি সুফল হল বাবা মাকে ডেকে বলে দিলেন-কাজলকে পড়াশোনা নিয়ে কখনো কিছু বলার দরকার নেই। ও ইচ্ছা হলে পড়বে, ইচ্ছা না হলে না। তাকে নিজের মতো থাকতে দাও।
আমি পরিপূর্ণ স্বাধীনতা পেয়ে গেলাম।
এই আনন্দের চেয়েও বড় আনন্দ, বিশেষ বিবেচনায় মাথামোটা শংকরকে প্রমোশন দিয়ে দেয়া হল। তার মা সেই খুশিতে তাকে একটা একনম্বরি ফুটবল এবং পাম্পার কিনে দিলেন।
গ্রীন বয়েজ ফুটবল ক্লাবের প্রতিষ্ঠা হল। আমি ক্লাবের প্রধান এবং শংকর আমার অ্যাসিসটেন্ট। আমাদের বাসার কাজের ছেলে রফিক আমাদের ফুলব্যাক। অসাধারণ খেলোয়াড়।
নানার বাড়ি দাদার বাড়ি
একদিন স্কুল থেকে বাসায় ফিরে দেখি–মাকে আজ অন্যরকম লাগছে। তার চেহারায় খুকি-খুকি ভাব চলে এসেছে। কথা বলছেন অনেকটা সুরেলা গলায়। ব্যাপারটা কী?